একজন কেরানীর মৃত্যু
(আন্তন চেখভ (১৮৬০ – ১৯০৪) মাত্র চুয়াল্লিশ বছরের জীবন। যে
দু’জন লেখকের লেখার মধ্যে দিয়ে রাশিয়ার মত একটি সুবৃহৎ দেশের প্রাণভোমরাকে ছোঁয়া
যায় তাদের একজন অবশ্যই ম্যাক্সিক গোর্কি, আরেকজন আন্তন চেখভ। সারা জীবনে অসংখ্য
ছোটগল্প লিখেছিলেন। সমকালকে ছাপিয়ে উঠে সেই সব সৃষ্টি আজও প্রাসঙ্গিক।
বিশ্বসাহিত্যে তাঁর মাপের ছোটগল্পকার খুব বেশী আসেননি। তাঁর ছোটগল্প সংকলনের
মুখবন্ধে তাঁর ন্যারেটিভ নিয়ে লিখতে গিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি লিখছেন, ‘Reading the works of Chekhov makes one feel as if it were a sad day in
late autumn, when the air is transparent, the bare trees stand out in bold
relief against the sky, the houses are huddled together, and people are dim and
dreary.’
Death of a Clerk গল্পটি রাদুগা পাবলিশার্স থেকে পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত চেখভের গল্প
সংকলনের প্রথম খন্ডের অন্তর্ভুক্ত। মূল রাশিয়ান থেকে ইংরাজীতে অনুবাদ করেছিলেন অ্যলেক্স
মিলার ও আইভি লিটভিনভ। প্রথম খন্ডে ১৮৮০ থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত লেখা গল্পগুলি সংকলিত
হয়েছে। এই খন্ডেই আমরা পেয়ে যাই তাঁর বিখ্যাত গল্প The Willow Tree, Tears Unseen
by the World, Letters to a Learned Neighbour, The Fat man and the Thin Man-সহ বেশ
কিছু গল্প।
এই গল্পটিতে এক কেরানীর ভীত-সন্ত্রস্ত জীবনের অনবদ্য ছবি এঁকে রেখেছেন চেখভ। একটা
ভয়, আতঙ্ক তাকে তাড়া করে ফিরেছে। হাজার হাজার কবন্ধ ভয়ের সামনে
দাঁড়িয়ে, এই ২০১৮ সালে যে কোনও পাঠকের মনে হতে বাধ্য, তিনিই সেই ইভান দিমিত্রিচ
চারকিয়েকভ। প্রতিদিন যাকে মরে যেতে হবে এক কালো কোটের ভেতরে শুয়ে...)
রাতটি চমৎকার; তার থেকেও বড় কথা কেরানী ইভান দিমিত্রিচ চারভিয়েকভের ঘটনাবিহীন জীবনে এমন রাত
খুব বেশী একটা আসেনি। অপেরা–গ্লাস নিয়ে একটি হলের দ্বিতীয় রো-এ বসে ‘ল্যা ক্লচিস দি কর্ণিভ্যিল’ নামে একটি অপেরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল ইভান।
তার কেরানী জীবনের দিকে তাকিয়ে সে মাঝে মাঝেই বিষন্ন হয়ে পড়ে। কতকিছু করার ছিল … কত স্বপ্ন ছিল। জীবন হবার কথা ছিল সবুজ উপত্যকার
মতো সুন্দর। সেটা হয়নি। হবেও না আর। কিন্তু আজ, এই সন্ধেবেলায় নিজেকে অস্বম্ভব ভারমুক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে এই জীবনের কাছে নতজানু হয়ে বসে থাকা যায়। ঠিক তখনই…
‘ঠিক তক্ষুনি, কোথা হইতে কী হইয়া গেল, বোঝা গেল না’-এই জাতীয় প্রকাশভঙ্গি আজকাল বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে। কিন্তু এই মায়াবী জীবন তো আকস্মিকের খেলা। এমন কিছু ঘটনা থাকে যেখানে এই জাতীয় প্রকাশ ছাড়া আর কোনও উপায়ও থাকে না। ফলে ঠিক তক্ষুনি … হঠাৎ ইভানের মুখ শুকিয়ে আমশি হয়ে গেল, চোখের মণিদুটি একবার ঘুরপাক খেয়ে আকাশের দিকে মুখ করে স্থির হয়ে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ইভানের। অপেরা গ্লাস থেকে চোখ সরিয়ে সে ভয়ার্ত শামুকের মত কুঁকড়ে গেল নিজের সিটেই। তার হাত-পা গুটিয়ে সেঁদিয়ে আসতে চাইছে পেটের মধ্যে। কিন্তু কিছুতেই সে রুখতে পারলো সেই শারীরবৃত্তিয় অমোঘ কর্মটিকে।
হ্যাঁচচচ্ছো …। তার নাক–মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো শ্লেষ্মা মিশ্রিত একটি দীর্ঘ শব্দ। সত্যি কথা বলতে কী, হাঁচি একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। চাষী থেকে শুরু করে পুলিশ ইন্সপেক্টর … মন্ত্রী থেকে সান্ত্রী, প্রত্যেকেরই হাঁচবার অধিকার আছে। এটি একটি জন্মগত অধিকার। এটাও অস্বীকার করা যায় না, প্রত্যেকেই এই হাঁচি নামক কর্মটি করে থাকে। মাঠে-ঘাটে … যেখানেই এটি আসে তাকে রোখা যায় না।
কিন্তু আজ এই অপেরার ভিতরে বসে নিজের ওপর চূডান্ত বিরক্ত হয়ে পড়ল ইভান চা্রভিয়েকভ। এদিক ওদিক তাকাল। গোয়েন্দার মত সতর্ক চোখে দেখতে চাইল, কেউ বিরক্ত হল কী না। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক মুছে নিল একবার।
আর এইবার
সত্যি সত্যিই তার বুক শুকিয়ে উঠল। সাপের শরীরের মত একটা ঠান্ডা ভয় তার শিরদাঁড়া
বেয়ে নেমে যেত শুরু করল। কারণ সে দেখতে পেল একদম সামনের সারিতে বসা এক ছোটখাটো চেহারার
বয়স্ক লোক খুব সন্তর্পণে তার চকচকে মাথা মুছতে শুরু করেছে্ন। লোকটি তার গ্লাভস পরা হাত দিয়ে ঘাড়ের
কাছটি মুছতে মুছতে কী যেন বিড়বিড় করে বলছেনও। লোকটি স্পষ্টতই বিরক্ত হয়েছেন। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল চারভিয়েকভের। কারণ অপেরার হালকা আলোতেও সে বিলক্ষণ চিনতে পেরেছে সেই
বয়স্ক লোকটিকে। তিনি আর কেউ নন, যোগাযোগ মন্ত্রকের বড়োবাবু …সিভিল জেনারেল ব্রিজালভ।
‘আমি এমন হাঁচান হাঁচলাম যে থুতু গিয়ে পড়ল ওনার মাথাতেই!’,
নিজের ওপর বিরক্তি জন্মাচ্ছে চারভিয়েকভের। ‘উনি আমার বড়বাবু নন। আমার টিকিও ওনার কাছে বাঁধা নেই, এটাও সত্যি। কিন্তু এইভাবে জনসমক্ষে হাঁচা চূড়ান্ত
অভদ্রতা’, নিজেকে
নিজেই এইসব সাঁতপাঁচ বোঝেলেও কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না সে। একবার ক্ষমা
চেয়ে নেওয়া উচিত।
চারভিয়েকভ কিছুটা
সামনের দিকে ঝুঁকল। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে, প্রায় ফিসফিস করে জেনারেলের কানে কানে বলার চেষ্টা
করল,
‘ক্ষমা করবেন স্যার, আমি হেঁচে ফেলেছি
… একশোবার সত্যি যে হেঁচে ফেলেছি। কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য ছিল
না ঠিক এইভাবে…’
জেনারেল ব্রিজালভ
একমনে অপেরা উপভোগ করছেন। এই সময়ে বিরক্তিকর কোনও কিছুকেই কেউ রেয়াত করে না। তিনিও করলেন না।
মাথা না ঘুরিয়েই বললেন, ‘এটা হতেই পারে। ক্ষমা চাইবার দরকার নেই ।’
চারভিয়েকভের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। লোকটি ক্ষমা করে দিলে তার চিন্তা দূর
হয়ে যেত, ‘আমাকে দয়া করে ক্ষমা
করে দিন স্যার… সত্যি সত্যিই আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি।’
‘আচ্ছা মুশকিল তো… এক কথা নিয়ে কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেছেন কেন? চুপ করে নিজের চেয়ারে বসুন। আমাকে একটু শুনতে দিন’।
একটু যেন মিইয়েই গেল চারভিয়েকভ। নিজের মনে একটু বোকার মত হাসল। তারপর অপেরার দিকে মন দিল।
অপেরার চমৎকার
কুশীলবেরা স্টেজের ওপরে প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে। সুর আর আলোর ফোয়ারা। কিন্তু এই এতো ফোয়ারার মাঝখানেও একটা অপরাধবোধ তাকে কুরেকুরে
খাচ্ছিল।
ইন্টারভ্যালে
হাসিহাসি মুখে ঘুরছে লোকজন। কিছুটা দূরে ফুরফুরে মেজাজে জেনারেল ব্রিজালভ। এর থেকে মোক্ষম সময় আর হয় না। নিজের যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব একপাশে সরিয়ে রেখে চারভিয়েকভ
এগিয়ে গেল তার দিকে, ‘স্যার…মানে আমি ইয়ে … একদম বুঝতে পারিনি… ক্ষমা করবেন। বিশ্বাস করুণ আমি ইচ্ছে করে আপনার মাথায় থুতু দিয়ে চাইনি…।’
জেনারেলের নিচের ঠোঁট বিরক্তিতে কেঁপে উঠল, ‘আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো… শুনুন, আমি ওটা ভুলে গেছি। আপনি কি এখনও চালিয়ে যাবেন’?
জেনারেল বিরক্তিতে
চারভিয়েকভের কাছে থেকে অন্যদিকে সরে গেলেন। কিন্তু চারভিয়েকভের চোখে ভাসছে জেনারেলের
চোখে-মুখে ফুটে ওঠা সেই ক্রুদ্ধ
ভঙ্গি। সে নিশ্চিত, জেনারেল তাকে এড়িয়ে
যেতে চাইছেন। অন্তত এই অপেরা-হাউসের ভেতরে তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে্ন তিনি। কিন্তু জেনারেল তাকে কিছুতেই ক্ষমা করেননি। নিজেকে খাঁচায় পড়া ইঁদুরের মত লাগছিল
তার। জেনারেলকে বুঝিয়ে বলা উচিত সত্যিটা। সে হেঁচেছে এটা সত্যি। কিন্তু জেনারেলের মাথায় ইচ্ছে করে থুতু ছেটাতে চায়নি সে। না হলে, আজ-না-হোক কাল জেনারেল
তাকে ভুল বুঝবেনই।
স্ত্রীর সঙ্গে
সব কিছু আলোচনা করে চারভিয়েকভ। আজও করল। কিন্তু আজ মনে হল সে বেশ হালকা ভাবে নিচ্ছে বিষয়টা। তার স্ত্রী একবার মাত্র শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যখন জানতে পেরেছিল ব্রিজালভ
তার স্বামীর ওপরওয়ালা নন,
তখন নিমেষের মধ্যে তার চোখমুখ থেকে আতঙ্কের ছায়াটা সরে গেছিল।
‘আমার মনে হয় তোমার আরেকবার ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসা
উচিত। না হলে উনি ভাবতে পারেন তুমি গেঁয়ো ভূত একটা…।’ এই জন্যই বিয়ের এতগুলো বছর পরেও বউকে
এতটা ভালোবাসে চারভিয়েকভ। ঠিক এই কথাটা ভাবছিল সে নিজেও।
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু জানো, আমি বার-দুয়েক ক্ষমা চাইবার চেষ্টা করেছিলাম। মানুষটা বেশ অদ্ভুত। একটা কথাও বলতে চাইলেন না আমার সঙ্গে। যদিও কথা বলবার সময়ও ছিল না ... অপেরা-হলের মধ্যে কী আর কথা বলা যায় ভালো
করে!’
মাথার চুলগুলো
কাঁচাপাকা। তার ওপর বিচ্ছিরি রকমের বড়ও হয়েছে সেগুলো। পরের দিন সক্কাল সক্কাল নাপিতের কাছে
গিয়ে চুল কাটিয়ে এসে একটু ভদ্রস্থ হল চারভিয়েকভ। তার প্রিয় কোট’টাকে বের করল আলমারি থেকে। তারপর
দুরুদুরু বুকে চলল জেনারেলের কাছে তার আচরণের
স্বপক্ষে সালিশি করতে।
তীর্থের কাকের
মত লোক বসে আছে সিভিল জেনারেল ব্রিজালভের রিসেপশন-রুমে। জেনারেল মানুষটি ভালো। নিজে হাতে সামলাচ্ছেন সব। একে একে ডেকে নিচ্ছেন সমস্যায় পড়া মানুষগুলোকে। তাদের কাকুতিমিনতিভরা কথা শুনছেন। চিঠিপত্তর পড়ছেন মন দিয়ে। এই ভাবেই কয়েকজনের আবেদন-নিবেদন শোনার পর জেনারেলের চোখ গিয়ে পড়ল
চারভিয়েকভের উপর। ওপরওয়ালা বোধহয় এভাবেই চোখ তুলে চান। চারভিয়েকভ বলতে শুরু করল, ‘কাল রাত্তিরে, মানে সেই দ্য আর্কেডিয়া ওপেরা হাউসে আপনি
অপেরা দেখতে গেছিলেন’… বুক শুকিয়ে আসছে চারভিয়েকভের, কিন্তু কথাগুলো বলতেই হবে তাকে, ‘মানে আপনি আমার সামনের
রো-এ ছিলেন আর আমি … বিশ্বাস করুন ইচ্ছে
করে করিনি… হয়ে গিয়েছিল… আমি হাঁচতে গিয়ে
আপনার মাথায় থুতু ভর্তি করে দিয়েছিলাম… দয়া করে আমায় ক্ষমা করে
দিন…।’
‘মাথাটা কি গেছে আপনার! সকালবেলা বাড়ি বয়ে
এই কথা বলা ছাড়া আপনার আর কোনও কাজ নেই?’, কথাটা পুরো শেষ না
করেই পরের সাক্ষাৎপ্রার্থীকে ডেকে নিলেন জেনারেল।
চারভিয়েকভের কলজে যেন গলা ঠেলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জেনারেল তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না। তার মানে তিনি এখনও তার ওপর রেগে আছেন। সেটাই স্বাভাবিক। হাঁচি ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু কিছুতেই থুতু গিয়ে পড়া উচিত
হয়নি জেনারেলের মাথায়। আরেকবার মরিয়া চেষ্টা করে জেনারেলকে বোঝাতেই হবে, সে ইচ্ছে করে কাজটা করতে চায়নি।
শেষ সাক্ষৎপ্রার্থীও
চলে গেছে। ঘর শুনশান। জেনারেল তার ভিতরের ঘরে ঢুকে পড়বেন
এইবার। চারভিয়েকভ প্রায় বিড়বিড় করে, অস্ফুট স্বরে কথাটা আবার পেড়ে ফেলল, ‘আমায় ক্ষমা করবেন স্যার…’, আরেকটু শুদ্ধ পরিশীলিত ভাষায় কথা বলা দরকার, ‘আমার হৃদয়ের উৎসস্থল থেকে
উৎসারিত অনুতাপ আমাকে বারবার পীড়িত করছে স্যার… কাল আপনার মাথায়
থুতু ছিটকে যাওয়াটা ঠিক হয়নি স্যার… যদিও আমি ইচ্ছে করে ওটা করিনি…।’
জেনারেল ফিরে তাকালো চারভিয়েকভের দিকে। মনে হচ্ছে তিনি এবার রাগে ফেটে পড়বেন।
‘আচ্ছা, আপনি কি বাড়ি বয়ে এসে আমার সঙ্গে মশকরা
করছেন, অ্যাঁ…’, কথাটা বলেই দুম করে মুখের
ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন জেনারেল।
সে মশকরা করছে!
বলে কী লোকটা। এর মধ্যে আবার ঠাট্টা-ইয়ার্কি এলো কোথা থেকে? এতবড় একজন সিভিল-জেনারেল … কেষ্টবিষ্টু মানুষ। এটুকুও কি বুঝতে পারছেন না, নিতান্ত একজন ভদ্দরলোক, যে হেঁচে ফেলেছে অপেরা দেখতে
দেখতে এবং সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবে থুতু ছিটিয়ে ফেলেছে সামনের মানুষটির মাথায়,
সে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছে! চারদিকের
মানুষজনকে ঠিক এই কারণের মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে চারভিয়েকভের। ভালোমানুষীকে লোকে দূর্বলতা ভাবে আজকাল। সে মনে মনে ঠিক করে নিল, আর মুখে নয়। এবার একটা চিঠি লিখবে সে জেনারেলের কাছে। অনুতাপ-ভরা চিঠি।
বাড়ি ফেরবার পথে
সেই চিঠির কথাই ভাবছিল চারভিয়েকভ। কিন্তু সে চিঠি লিখল না। বলা ভালো, চিঠিটা লিখতে পারল না। ঘন্টার পর ঘন্টা সাদা পৃষ্ঠার সামনে বসে রইল। একটাও শব্দ লিখতে পারল না সে। জেনারেলের কাছে ক্ষমা চাইবার মত জুতসই শব্দ কিছুতেই মাথায়
এলো না। কিছুটা নিরুপায় হয়েই তাকে আবার পরের দিন জেনারেলের কাছে যেতে হল।
আজও রিসেপশন-রুমে লোক ভর্তি। কিন্তু জেনারেল তার দিকে একবার চাইবেন ঠিক। জেনারেলের কাছে কেউ এলে জেনারেল তার
দিকে কোনও–না–কোনও সময় মুখ তুলে চান।
চারভিয়েকভ আজ একটা ব্যাপারে মনঃস্থির করে এসেছে। আজ সে কালকের মত ইতস্থত করবে না।একটু ফাঁক পেতেই কোনও রকম গৌরচন্দ্রিকা
না করেই সে বলতে শুরু করল, ‘শুনুন মশাই,
আমি কাল আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি’, নিজের গলায়
আত্মপ্রত্যয়ের সুর শুনতে পায় চারকিয়েকভ।
জেনারেল সন্দিগ্ধ
দৃষ্টিতে তার দিকে ফিরে তাকালেন। এই অন্তিম সুযোগ। চারভিয়েকভ আবার বলতে শুরু করে, ‘কিন্তু স্যার, আপনাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল
না। বিশ্বাস করুন, আমি এসেছিলাম ওই যে
হাঁচি … যে হাঁচিতে আমার মুখ থেকে থুতু উড়ে গিয়ে পড়েছিল আপনার
মাথায়, সেটা নিয়ে ক্ষমা চাইতে। আর হাসি-ঠাট্টার কথাই যদি বলেন তো বলি,
আপনাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। আর তাছাড়া আমি সেই সাহস দেখাবই বা কী করে! আমরা যদি একবার এইভাবে মানুষকে নিয়ে হাসি- ঠাট্টা শুরু করি তাহলে তো আমাদের মধ্যে কোনও শ্রদ্ধাবোধই থাকবে না
… ওপরওয়ালাদের মাণ্যগণ্য করাই তো আমরা ভুলে যাব… তাই না!’ চারভিয়েকভ আবিষ্কার করল কথাগুলো বলার সময়ে আবার
তার গলা শুকিয়ে আসছে। পা’দুটো কাঁপছে থরথর করে।
‘বেরিয়ে যাও … বেরিয়ে যাও এখান থেকে…’,
রাগে চোখ লাল হয়ে গেছে ব্রিজালভের। কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
‘আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি স্যার’, ভয়ে সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে আসছিল চারভিয়েকভের। গলার ভেতর কে যেন খড় পুরে দিয়েছে একগাদা।
‘বেরিয়ে যাও!’, মেঝের দামী কার্পেটে রাগে পা
ঠুকছিলেন ব্রিজালভ।
চারভিয়েকভের
মনে হল, একটা বর্শা যেন তাকে
এফোঁড়-ওফোঁড় করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ব্রিজালভের রিসেপশন-রুমের দরজা ঠেলে সে
বেরিয়ে পড়ল। কোনও শব্দ সে আর শুনতে পাচ্ছে না। কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছে না সে।
কোনও রকমে রাস্তায়
নেমে হোঁচট খেতে খেতে, এতোলবেতোল পায়ে বাড়ি ফেরে সে। একটা যন্ত্রের মত বাড়ি ফেরে চারভিয়েকভ। তার প্রিয় অফিস-কোট’টি পরে সোফায়
শুয়ে পড়ে। শুয়েই থাকে।
আর সেই সোফায়,
সেই অফিস-কোটের মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে মৃ্ত্যু
ঘটে তার।
No comments:
Post a Comment