Sunday, October 14, 2018

চার মেয়ের অনুবাদঃ যশোধরা রায়চৌধুরী






ভ্যালেন্টাইন/ ক্যারল অ্যান ডাফি


( ক্যারল অ্যান ডাফির জন্ম স্কটল্যান্ডে, ১৯৫৫ সালে ব্রিটেনের পোয়েট লরিয়েট সম্মানে  সম্মানিত হয়েছেন মে  ২০০৯ তে পেশায় অধ্যাপক উল্লেখ্য বই,   Standing Female Nude (1985), এটি স্কটিশ আর্টস কাউন্সিল পুরস্কারে ভূষিত হয়, Selling Manhattan (1987), বই পেয়েছে সমারসেট মম অ্যাওয়ার্ড  Mean Time (1993), Rapture (2005) ( টি এস এলিয়ট পুরস্কার প্রাপ্ত) ক্ষমতা, লিঙ্গবৈষম্য,  হিংসা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর লেখা  কবিতাগুলি সরল ভাষায় লিখিত আর তাইই, এমনকি ইশকুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছেও তিনি জনপ্রিয়) 



লাল গোলাপ না , স্যাটিনের হৃদয় না।

তোমাকে দিলাম একটা পেঁয়াজ। 

ব্রাউন পেপারে মোড়া এক চাঁদ।

আলো নিশ্চয়ই দেবে,

প্রেমের  সযত্ন  উন্মোচনে


এই যে। এ তোমাকে অন্ধ করবে কান্নায়

ঠিক প্রেমিকেরই মত।

তোমাকে আয়নায় দেখাবে

ঝাপসা আর দুঃখী এক ছবির মত।


আমি সৎ হতে চাইছি।

মিষ্টি কার্ড না, কিসোগ্রাম* না।

তোমাকে দিলাম একটা পেঁয়াজ। 

এর হিংস্র চুম্বন তোমার ঠোঁটে লেগে থাকবে

আগ্রাসী আর একনিষ্ঠ

যেমন আমরা, 

যতক্ষণ পারি তেমন থাকতে আমরা। 

নাও।


এর প্ল্যাটিনাম-লুপ শুকিয়ে এঁটে বসবে বিবাহ-অঙ্গুরীয়ের মত

যদি চাও। 


মারাত্মক।

এর গন্ধ তোমার আঙুলে লেগে থাকবে

আঁকড়ে থাকবে তোমার ছুরিকে। 



*কিসোগ্রামঃ একটি টেলিগ্রাম যা পৌঁছে দেবার সময়ে বাহক প্রাপককে চুম্বন করেন, প্রেরকের হয়ে।




স্ট্রেচ মার্ক - এলিজাবেথ বার্টলেট


 বিংশ শতাব্দীর এমিলি ডিকিনসন হিসেবে অভিহিত, ১৬ টি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতাএলিজাবেথ বার্টলেট  ১৯১১-১৯৯৪) মার্কিন কবি কবিতায়টুয়েলভ টোনধারার প্রবক্তা তাঁর ১৯৬৮ বই, Twelve-Tone Poems,  এই ফর্ম টির পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে রচিত এলিজাবেথ বার্টলেট আমেরিকায় লিটারারি অলিম্পিক্স এর প্রতিষ্ঠা করেন 



ছোট শহরে জেগে শুয়ে শুয়ে 

কবিদের কথা ভাবি। বেশিরভাগ কবিই

পুরুষ। অথবা আইরিশ। হলুদ ফোটো 

হয়ে থাকেন, চার অক্ষরের গালি দেন

শুয়োর পুড়িয়ে খান, অথবা দুবার বিয়ে করেন

বেশিরভাগ বই ও পত্রিকা

সম্পাদনা করেন। 


অধিকাংশ কবি, যাঁরা পুরুষ, তাঁরা 

কবিতা পাঠের সময়ে আগে ডাক পান

আমাদের মধ্যে যারা হুরিপরি তাদের পছন্দ করেন না,

নারীবাদীদেরও না।  হয় বেশি বয়স্ক নয় বেশি কাঁচা

নয় বেশি আবেগসর্বস্ব। মাসিক পত্রিকার সময়ে

একমাত্র আমাদের দরকার পড়ে, 

তাও ওঁদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনেরই।


শবযাত্রার মহিলাদের মত কালো গাউন পরে ওঁরা 

বন্ধুরা ওঁদের যান ক্যাম নদীতে নৌবিহারে ।

 অন্যেরা অক্সফোর্ডে

ঠিক কী করেছেন জানা নেই, গাড়িঘোড়া

চাপা না পড়ে, ঝর্নার জলে চান করে

আকন্ঠ মদ্যপান করে, অন্য একটা নীলবর্ণ তাঁদের।


এঁরা বেশির ভাগ পড়ান, এবং কেউ কেউ তো 

নিশ্চয়ই বাবা।  তবে ওঁদের তো স্ট্রেচ মার্ক নেই

মসৃণ পেটের ওপর, যাতে সেটা প্রমাণ হয়ে যায়।

অন্তত আমরা তো জানি আমাদের সন্তানেরা

আমাদেরই, নিজস্ব। ওরা কখনো সঠিক 

বলতে পারেন না, তবে কবিতাগুলো সম্বন্ধে 
পারেন।



 ‘আমি যখন তাকিয়ে ছিলাম তোমার মুখের দিকে’-সনেট


এডনা সেন্ট ভিনসেন্ট মিলে ( ১৮৯২-১৯৫০)

মার্কিন কবি নাট্যকার ১৯২৩ পান পুলিৎজার পুরস্কার তিনি পুলিৎজার পাওয়া তৃতীয় নারী নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ন্যান্সি বয়েড নামে গদ্য লিখেছেন শ্রেষ্ঠ কিছু সনেটের জন্য  সমধিক বিখ্যাত 



আমি যখন তাকিয়ে ছিলাম তোমার মুখের দিকে

সেখানে ছিল কত অবাধ সপাট উজ্জ্বলতা... 

ছিল খানিক কুয়াশা , ওই ঝলমলানির ধাঁধায়

তোমার ভয়ঙ্কর সে রূপের বিপুল অসহ্যতা ।

মুখ ফেরাই অনিচ্ছায় ও-আলোর থেকে, স্বামি!

ডুবেছি ভ্রান্তিতে, আর মনেও আতান্তর

চোখ-ধাঁধিয়ে-অন্ধ একটা আবোলতাবোল আমি -

অনেকক্ষণ সূর্যপানে চেয়ে থাকার পর।

তারপরে ফের দিনগত পাপক্ষয়ের ঘর

ছোট্ট, ফিরে অনিশ্চিত, কাটাই খানিকক্ষণ

দুর্ভেদ্য আবছা ধোঁয়া অন্ধকারের সর

চারপাশে, আর জিনিষগুলোও অচেনা অচেতন - 

হাতড়ে হাতড়ে ঘরের মধ্যে, হাঁটার এবং থামার

যতক্ষণ-না চোখ সয়ে যায় অন্ধকারেই আমার। 




ব্লাগা দিমিত্রোভা (১৯২২-২০০৩)



বুলগেরিয়ার কবি, রাজনীতিবিদ ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, নিজের দেশে কম্যুনিস্টদের অত্যাচারেরও বিরোধিতা করে বিরাগভাজন হয়েছেন তদানীন্তন সরকারের আশির দশকে মূলত লিখেছেন  নিজের উপন্যাস প্রকাশের জন্যও তাঁকে লড়াই করতে হয় ব্লাগা ছিলেন একজন স্লাভিক ভাষাবিদ এবং বুলগেরিয়ার রোডোপস পার্বত্য অঞ্চলের ইতিকথা লিপিবদ্ধ করেছেন   



একাকী নারী, রাস্তায়

সত্যিই ঝুঁকি আর অসুবিধে এটা 

এখনো এ ‘পুরুষের’ পৃথিবীতে ।

উদ্ভট কোন অতর্কিত মোলাকাত

প্রতিটি বাঁকের মুখে রয়েছে যেন।

এমনকি, সড়কেরাও কৌতূহলী চোখ দিয়ে


বিঁধিয়ে দিচ্ছে তোমায়।

একাকী নারী, রাস্তায় ।

তোমার একমাত্র প্রতিরোধ

তোমার প্রতিরোধহীনতাই।


কোন পুরুষকে করে নাওনি তোমার ক্রাচ,

ভর দেবার জন্য।

বরং ভর দাও একটা গাছের গুঁড়িতেই

ঝড় থেকে বাঁচো একটা দেওয়ালে ভর দিয়েই।

একা রাস্তায় নেমেছিলে

সে-পুরুষের সঙ্গে সমানে সমানে মিলবে বলে

তাকে সত্যিকারের ভালবাসবে বলে।


তুমি কি নিজের গন্তব্যে পৌঁছবে,

না কি উলটে পড়বে, কাদা মাখামাখি হয়ে? 

না কি চোখ ধাঁধিয়ে যাবে দৃশ্যপটে?

জানা নেই এখনো, তবু তুমি একগুঁয়ে।


পথেই ওরা তোমাকে ভেঙ্গেচুরে দেবে হয়ত

তবু এই বেরিয়ে পড়াটুকুই

তোমার সাফল্য।

একাকী নারী, রাস্তায়

তবু তুমি চলেছ

তবু তুমি থামনি।

একজন পুরুষ কখনো

এতটা একা হয়না

যতটা এক একা নারী।


তোমার সামনে গোধূলি বন্ধ করে দিল

একটা দরজা। তালা দেওয়া। 

রাতের বেলায় একাকী নারী

কখনো নেমো না রাস্তায়।

সকালে যদিও সূর্য দারোয়ানের মত

তোমার চোখের দৃষ্টি খুলে দেয়

তবু তোমাকে ছায়াও মাড়াতে হয়।

পেছনে তাকিও না।

প্রতিটি পদক্ষেপ নিচ্ছ

বিশ্বাসের শপথ নিয়ে

সেই ছায়াচ্ছন্ন মূর্তির প্রতি

যার ভয় ওরা তোমাকে বহুদিন দেখিয়ে এসেছে।

পাথরে তোমার পায়ের শব্দ ওঠে।

একাকী নারী , রাস্তায়

সবচেয়ে পেলব আর সবচেয়ে সাহসী পা ফেলছ

অপমানিতা মা ধরিত্রীর বুকে।

সেও, আর এক একাকী নারী। রাস্তায়।





হোটেলের ঘর

( ভিয়েনা, ১৯৬৬)



তোমাকে দেওয়া হল একটা নম্বর।

যেমন দেয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।

ঢুকে পড়, স্বাধীন হয়ে যাও

একমাত্র সম্ভাব্য স্বাধীনতা।


কোন ছাপ নেই

আগের অতিথির।

আলোবাতাস নেই

তবু, একমাত্র এখানেই অন্তত, তুমি নিঃশ্বাস নিতে পার।


একটা বেসিন, একটা খাট। একটা আলমারি।

ছাই ছাই রঙের ওয়ালপেপার।

এক্কেবারে নৈর্ব্যক্তিক।

কিন্তু এখানেই এসে তুমি নিজের চেহারাকে খুঁজে পেলে।


বিছানার পাশে আলোটা জ্বালাও

কথা আদানপ্রদান করবে যে,

কেউ  নেই , এমন।

তবু পৃথিবীর স্পর্শে তুমি শিউরে ওঠো।

কোন রেশ

থাকবে না তোমার।

কোন স্মৃতি না।

কিন্তু তোমার স্বপ্নগুলো তুমি মনে রাখবে বছরের পর বছর।


অনন্ত চুম্বন রাখা আছে

বাঁধাছাঁদা স্যুটকেসের পাশে।

এক অবিচ্ছেদ্য আলিঙ্গনে বাঁধা

তোমার পকেটে, তোমার টিকিট।

সকালের সূর্যালোক

তোমার ঘুম ভাঙালো  অচেনা এক কোণ থেকে।

তুমি কোথায়? একটা হোটেলের ঘরে...

এটাই তোমার সত্যিকারের ঘরবাড়ি।



জল-মোষ

( হ্যানয় ১৯৭২)


বৃষ্টি গুঁড়োগুঁড়ো পড়ছিল, সরছিল

কেঁপে কেঁপে ওঠা সবুজ ধানের খেতে

প্রতিটি ফোঁটায় একটি করে শস্যদানা জন্মাবে

লটপটে-কান কলাপাতাগুলো

মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়াল

আমি ডুবে গেলাম প্রাচীন নীরবতায়।


এক বৃদ্ধ এক মোষ নিয়ে

দাঁড়িয়েছিল  পথের শেষ প্রান্তে

দুজনেই কাঠে কুঁদেকাটা।

কথা না বলেই

বৃদ্ধ কলাপাতার আচ্ছাদন সরিয়ে

নিজের বাড়িতে ঢুকতে দিলেন আমায়

একটা উঠোন পেরিয়ে গেলাম

দাঁড়িয়ে পড়লাম একটা হাঁ করা ফাঁকের সামনে

কবরের চেয়েও বড় একটা গর্তের সামনে।


ছাই থেকে উঠে আসছে ধোঁয়া

কালো ধোঁয়া কুন্ডলী পাকাচ্ছে বাতাসে

দেওয়ালের বদলে শুকনো কুয়ো।

গৃহকর্তা নেমে গেলেন নীচে

ডাকলেন হাত নেড়ে

গর্তের ভেতর পড়ে থাকা তাঁর পরিবারের কাছে।

তাঁর নাতি -  এক গোছা চুল,

তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী -  একটা পাত্রের হাতল,

তাঁর নওজোয়ান ছেলেরা – রক্তাক্ত পাথর,

তাঁর মিষ্টি মেয়েরা – ছেঁড়া কাপড়ের সুতো

তাঁর জামাইরা – স্যান্ডালের ফিতে

তাঁর ছেলের বউরা – মাটির দলা

বেড়াতে আসা ভাই – ভাঙা টুল

তাঁর নাতির ছেলে – একটি ভ্রূণ

তার মায়ের পেটে -  কলাগাছের চারাটি...

চারাটা যেন তখনো গজিয়ে চলেছে

একটা সবুজ কুঁড়ি উঠেছে , ঠিক যেন

বাচ্চার মুঠি করা হাত।

সৎ একটা জীবন কাটানোর পর

একটা বিশাল পরিবারকে পালন করার পর

একা একা; বেঁচে থাকা বার্ধক্যে

একমাত্র নিজের মোষটার সঙ্গে

একমাত্র জীবিত প্রাণীটি

দুঃখ ভাগ করে নেবার জন্য


আমেরিকার আবিষ্কারগুলি

ওইসব যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তির বিস্ময়,

ও আচ্ছা, এসব তাহলে এইজন্য? 

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে