গ্রন্থ- নিচু গিলোটিন
/অর্ণব সাহা/ হাওয়া কল /১৫০ / প্রচ্ছদ-প্রস্তুতি – বিতান চক্রবর্তী
বাংলা কবিতায় এখন সেইসব কবিদের সংখ্যা বাড়ছে যারা বিমূর্ত ঢেউয়ের বিষাদে ও
ধোঁয়ায় কাবু হয়ে পড়েছেন আর সমানে ন্যাকামো চালিয়ে যাচ্ছেন । এইসব কবিরা এত শান্ত
আর এঁরা নীরবতা এত পছন্দ করেন যে মাঝে মাঝে মনে হয় শুধু তৎসম শব্দ , দর্শন ভারাক্রান্ত
চলচ্ছবি ও কিছু শান্ত আর কাব্যগন্ধী শব্দের পারমুটেশন ও কম্বিনেশনই বুঝি কবিতা ।
এঁদেরকে বাজার করতে দেখা যায় না , এঁদের রাস্তাঘাটে ধাক্কা খাওয়া প্রতিদিনের লড়াই
নেই , এইসব কবিরা শুধু বেছে নিয়েছেন নীরব আর উদাস হওয়ার একটা জানালা আর ক্রমাগত
ছুঁড়ে যাচ্ছেন তাঁদের দর্শন ও বিষণ্ণতার ইতিবৃত্ত । এঁদের জন্যে বাংলা কবিতার ডাক্তার প্রেসক্রিপশান করতেই পারেন
অর্ণব সাহার কবিতা । কারণ হচ্ছে এখানে বানিয়ে তোলা শান্ততার কথা নেই । বাস্তব দৃশ্য
আর আমাদের চারপাশের আবহ পাওয়া যায় । সেইসব দৃশ্য যা আমাদের জীবন । সেইসব দৃশ্য যা পাঠকের
পড়ে মনে হবে যে সমস্যাসংকুল ভারতীয় উপমহাদেশে তার জন্ম ! জীবন্ত এইসব দৃশ্য পাঠককে নিয়ে যাবে অন্য এক জীবন
দর্শনের দিকে যা তত্ত্বসংকুল নয় অথচ যার মধ্যে লাগালাগি করে বেঁচে আছে ভাবনা আর
অন্য এক কল্পনা ।অতিশান্ত কবিদের বড়ই উপকার হবে এঁদের কবিতা পড়লে । কবিতা যে
বস্তুত তত্ত্বকথা নয় , কবিতা যে দর্শন নয় , কবিতা যে শুধুমাত্র জীবনমুখী
স্টেটমেন্টও না , তা যে মূলত এক কনফ্লিক্টও সেই বোধ তীব্র হতে পারে এই কবিতা পড়লে
। অর্ণব সাহা সেইরকম একজন স্বপ্নসন্ধানী
যিনি একটা মানুষেরই মতো একা হয়ে যাওয়াকে ভয় পান , একা হয়ে যাওয়াটিকে ব্যবহার করেন
না তাঁর কবিতায় , তাকে নিয়ে ব্যবসা করেন না ।
অর্ণবের কবিতায় ভাষাপ্রয়োগ এতো নিজস্ব যে কবিতা পড়ে বলে দেওয়া যায় কার লেখা ।
এক ভাষা যা মূলত আমাদের বিষয়ের দিকে নিয়ে যায় দ্বর্থহীনভাবে , এক বিষয় যা ভাষার
দিকে টেনে আনে আমাদের ------- মূলত ভাষাবোধ আর বিষয়বোধ , তাই ,আলাদা করা যায় না ।
কখনও সে হয়ে ওঠে পলিটিক্যাল কন্টেন্টও , কারণ ব্যক্তি মানুষের জীবন থেকে কখনই
আলাদা করে রাজনীতিকে দেখেন নি অর্ণব
সারাটা রাত্রি ঘুমোতে পারি না ... এত ভয় করে ! /
কেউ নেই শুধু পাশের ঘরের খোলা জানালায় / যেন কার ছায়া ডাইনে ও বাঁয়ে দল খেয়ে যায় /
যেন ভিনগ্রহ থেকে একজন ক্ষীণ অশরীরি / আমার শোবার ঘরেও তীব্র নজর রাখছে :/ চাদরে , বালিশে , তোমার কান্না
, আত্মরতির / সমান্তরাল নিয়মে কতটা কাছাকাছি আসে ! / হয়ত জীবন মাংসপিণ্ড , নীচু
গিলোটিন / নেমে আসবার আগেও শান্ত স্বরে কথা বলে
অনর্থক মহৎ
সাজতে চেষ্টা করে তারাই যারা বোকা । অর্ণবও তাই নিজের হিউম্যান এপ্রোচগুলো সামনে
নিয়ে আসেন । সেটা কখনও খোলামেলা শরীর নিয়ে স্বীকারোক্তি , কখনও তাকে আশ্চর্য
মুন্সিয়ানায় উপস্থাপন করে ফেলেন । আর তার এত তীব্রতা যে বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে
হয় , মনে হয় না কখনই এ বানানো । ভিড়ের হৃদয় থেকে , এইভাবে , তাঁর কবিতা আলাদা হয়ে
যায় । তাঁর টেক্সট এবং ইন্টার টেক্সচুয়াল ভায়লেন্সে দিশেহারা হয়ে যায় পাঠক
চুম্বনের মধ্যে থাকে ক্ষমতা- কাঠামো / সঙ্গমে
লুকোনো আছে ক্ষমতার বিষ / যদি পারো ক্ষমতার অনু পরমানু / ধ্বংস করো , আদি গঙ্গা
রক্তে ভেসে যাক /
রক্তের আরেক নাম ক্ষমতার রং / ফেসবুক ক্ষমতার উঠোন
, সীমানা / ক্ষমতা কলতলায় জন্ম নেয় ,মরে /
অকালহোলিতে তার লাশ পুড়ে যায় / ...
ভিড়ের হৃদয় থেকে তাঁর কবিতা আলাদা এই অর্থে যে
ব্যক্তিজীবন ধীরে ধীরে রূপ নেয় সমষ্টির স্বরের ভিতর যেখানে তাঁর ‘আমি’ আসলে তাঁর
সময়ে তাঁর বয়েসের , মানসিকতার আর তাঁর ওয়েভ লেন্থের যেকোনো মানুষের প্রতিনিধি । সে
মানুষ যে খোলামেলা , রাগী , বিষণ্ণ , সেই মানুষ যে তার নিজস্ব নারীকে পেতে চায়
গভীর করে ,সেই মানুষ যে রাজনৈতিক , সেই মানুষ যে দিলখোলা খিস্তিবাজ আর সেই মানুষ যে কবিতা লেখাকে অন্য
পৃথিবীর মনে করে না । সেই মানুষ যে জীবনযাপন আর কবিতাযাপন এক সারিতেই এনে ফেলে ।
এই সময়ে
দাঁড়িয়ে আমরা অনেকেই সে নিঃসঙ্গ মানুষটি যাকে দেখতে হয় তার ঘাতক , তার অস্ত্রটিকে
। বস্তুত অর্ণব সাহার বই ঠাকুরের গীতাঞ্জলি নয় যা আশ্রয় দেয় আমাদের , বরং সে
আমাদের মাথার ছাদ কেড়ে নেয় , আমাদের উপদংশসর্বস্ব জীবনকে হা হাট করে দেখতে চায় ,
টেনে এনে ফেলতে চায় আমাদের এক বীভৎস অন্ধকারের দিকে ।
বাংলা কবিতার অতি শান্ত স্বরের কবিরা তাই অনেক কিছু
পাবেন এই কবিতাবই পড়লে ।
No comments:
Post a Comment