Friday, October 12, 2018

গল্প- নাদিন গার্ডিমার ( অনুবাদ- এনাক্ষী রায়)





নাদিন গার্ডিমার



আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ লেখিকা নাদিন গর্ডিমার ছিলেন আপাদমস্তক বর্ণবাদবিরোধী। তিনি ছিলেন ইহুদি। বাবা এসেছিলেন লিথুয়ানা থেকে, মা ইংল্যান্ড থেকে। গর্ডিমার স্পষ্টতই ঘোষণা  করতেন, তিনি এবং তাঁর পরিবার সম্পুর্ণ ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাস করতেন।নাডিন গর্ডিমার সাহিত্যকর্মের জন্য তেইশটিরও বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।
ওয়ান্স আপঅন এ টাইম  1989 সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। নাডিন গর্ডিমার 1923 সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের কাছাকাছি একটি ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইউনিভার্সিটি অব  উইটওয়াটারসর‌্যান্ড থেকে স্নাতক হন। তবে ফিরে এসে তার নিজের দেশে বসবাস শুরু করেন। গার্দিমার একজন অসাধারণ লেখক, তার 20 টিরও বেশি বই প্রকাশিত (উপন্যাস এবং সংক্ষিপ্ত গল্প সংগ্রহ)। ফিকশন জন্য ইংল্যান্ডের মর্যাদাপূর্ণ বুকার পুরস্কার ছাড়াও, তিনি 1991 সালে সাহিত্য জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।


একদা


কোনও এক দেশে, এক শহরতলির একটি  বাড়িতে, এক সুখী দম্পতি বাস করতো। পরস্পরকে খুব  ভালোবাসত তারা । তাদের ছিল খুব আদরের একমাত্র ছেলে আর ছেলেটির ছিল খুব ভালোবাসার একটি পোষা বেড়াল আর কুকুর।  একখানা গাড়ি ছিল তাদের, আর ছুটিছাটায় বেড়াতে যাবার জন্য একটা ক্যারাভান। বাচ্চাটি তার বন্ধুদের সঙ্গে বাগানে খেলাধুলার সময় যাতে পড়ে না যায় সেজন্য বাড়ির বাগানের ছোট্ট সুইমিং পুলটা বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন  তারা। পরিচারিকাটি বিশ্বস্ত ছিল। আর বাগান পরিচর্যার জন্য রেখেছিলেন একজন ঠিকা মালি, মাঝে মাঝে এসে সে বাগানের দেখাশোনা করে যেত। পাড়া প্রতিবেশীরাই তার হয়ে সুপারিশ করেছিল, ফলে তার বিশ্বস্ততা নিয়েও কোনো প্রশ্ন ছিল না।  ভালো থাকার জন্য যতরকম সতর্কতা নেওয়া দরকার, তারা নিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা সতর্ক ছিলেন কারণ তার জ্ঞানের নাড়ি টন়্টনে রুগ্ন বুড়ি শাশুড়িটি পই পই করে বারণ করে দিয়েছলেন যাকে তাকে বাড়িতে না ঢোকাতে। স্বাস্থ্যবীমার সামাজিক সুবিধা যারা পায় তারা সেই দলেই পড়তেন। তাদের পোষা কুকুরটাও পর্যন্ত  লাইসেন্সপ্রাপ্ত ছিল। আগুন, বন্যায় ও চুরিতে সম্পত্তির   ক্ষতি হলে তারও বীমা করে রাখা ছিল। স্থানীয় প্রতিবেশীরা মিলে নিজেরাই  আসেপাশের বাড়িগুলোর সুরক্ষার ব্যপারে ব্যাবস্থা নিয়েছিলেন একটি কমিটি গড়ে।  কমিটি প্রত্যেককে তাদের গেটগুলির জন্য একটা করে ফলক সরবরাহ করেছিল। ফলকগুলোর প্রত্যেকটাতেই  বড় বড় অক্ষরে । “ সাবধান করা হইতেছে” লেখা। এই লেখার সঙ্গে ছিল একটি মুখোস পরা লোকের রেখাচিত্র যার থেকে বোঝার উপায় নেই দুর্বৃত্ত শ্বেতাঙ্গ না কৃষ্ণাঙ্গ, এতেই প্রমাণ হয় বাড়ির মালিক বর্ণবিদ্বেষী ছিলেন না।
তবে দাঙ্গার জন্য বাড়ি বা সুইমিং পুল, গাড়ি এসব সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার কোনো  বীমা ছিল না। দাঙ্গা ছিল, এই শহরতলীর বাইরে। যেখানে চারপাশে বিভিন্ন বর্ণের লোক ছিল। এই শহরতলীতে চেনাজনা বিশ্বস্ত লোক ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার ছিল না।

চপি ও টি সোঙ্গা :.মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা, দুজন মানুষ
পরচারিকা আর মালি, সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই, স্বামী আশ্বস্ত করেন  স্ত্রীকে। তিনি কিছুদিন থেকে ভয়ে ভয়ে আছেন, কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ির সামনে রাস্তায়। তার খালি মনে হচ্ছে  এই ওরা ছিঁড়ে ফেলছে ফলকটা, যেখানে লেখা “সাবধান করা হইতেছে।” এই বোধহয় গেট খুলে ঢুকে পড়ছে ক্যাবলার মতো। স্বামী বললেন,
— সোনা, বাইরে পুলিস আর সেনারা আছে, টিয়ার গ্যাস আর বন্দুক দেখিয়ে ওদের বাইরে বের করে দেবে।
স্ত্রীকে তিনি ভালোবাসেন তাই খুশি করার জন্য একথা বলছিলেন। কিন্তু
বাইরে বাস পুড়ছিল। গাড়িতে পাথর  এসে লাগছিল, স্কুলের বাচ্চাদের গায়ে পুলিশের গুলি লেগেছিল।  এসব দৃশ্যত শহরতলীর শোনার বাইরে ছিল। অনেক ভেবেচন্তে তিনি স্বয়ংক্রিয়  কন্ট্রোলড গেট ফিট করলেন। “সাবধান করা হইতেছে” সাইনবোর্ডটি যে কেউ টানাটানি করলে বা দরজা খুলতে চেষ্টা করলে ঘোষণা হবে। ওনার উদ্দেশ্য ছিল একটা বোতাম টিপে ঘরের ভেতর থেকে রিসিভারের মাধ্যমে বাইরে কথা বলে নেবেন। বাচ্চাটির ডিভাইসটি এত পছন্দ হল যে সে এটাকে ওয়াকি-টকি বানিয়ে  তার খুদে বন্ধুদের সাথে চোর পুলিশ খেলা শুরু করে দিল।

দাঙ্গা দমন হয়েছিল, কিন্তু শহরতলির উপকণ্ঠে অনেক চুরি হচ্ছিল এবং পাড়ার   একজনের বিশ্বাসী কাজের লোককে হাত পা আলমারিতে বেধে, বন্ধ করে রেখেছিল চোরেরা, পরিচারকাটি  মালিকের বাড়ির সমস্ত কিছুর দ্বায়িত্বে ছিল। বন্ধুর এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় এই পরিবারের বিশ্বাসী পরিচারিকাটিও এমন হতাশ হয়ে পড়ে যে সে মালিকের  কানের মাথা খেয়ে দেয় আরো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তার নিজের, সেই ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী আর ছোট ছেলেটির, সঙ্গে সম্পত্তিরও দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তিনি তার নিয়োগকর্তাকে বার বার অনুরোধ করতে শুরু করেন, বাড়ির দরজা এবং জানালার সাথে সংযুক্ত করে একটি এলার্ম সিস্টেম ইনস্টল করার জন্য।  
গিন্নিরও তাতে মত ছিল
- ও ঠিকই বলেছে, এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা  করা হোক।।

কাজেই বাড়ির প্রত্যেক দরজা জানলায় চুম্বক তারে সংযুক্ত করে এলার্ম লাগানোর পর   হাঁফ ছেড়ে, আনন্দে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল তারা। কিন্তু তারা আকাশ, গাছপালা দেখে অর্গলের ভেতর দিয়ে। একদিন যখন ছোট্ট  ছেলেটির পোষা বেড়ালটা ফ্যানলাইটটার ওপরে চড়ে বসলো রাতে তার ছোট বিছানায় যাবার জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই সব আলার্মগুলো বেজে উঠল একসঙ্গে।  আলার্মগুলো সারা বাড়ি জুড়ে একে অপরের আওয়াজ এফোঁড় ওফোঁড় করে বাজতে শুরু করে দিল। ঠিক চোর এলে যেমন বাজার কথা ।
এর পর থেকে প্রায়ই কারো পোষা বেড়াল বা কখনো ইঁদুরের জন্য আলার্মগুলো আলোড়ন তুলে বেজে ওঠে। আলার্মগুলো বাতাস কাটাকাটি করে ভ্যাড়ার পালের মতো তীব্র আওয়াজ তোলে।  শহরতলির কেউ আর অসন্তোষ প্রকাশ করে না, ব্যাঙের ডাক বা ঝিঁঝিঁ পোকার পায়ের ঘষটানির বাদ্যের মতো এই ইলেক্ট্রনিক ঘ্যানঘেনে আলাপেও সবাই খুব জলদিই অভ্যস্ত হয়ে গেলে,  চোররা করাত দিয়ে লোহার তার কেটে ঘর ভেঙে, মূল্যবান জিনিস পত্র, হাইফাই সরঞ্জাম, টেলিভিশন সেট, ক্যাসেট প্লেয়ার ক্যামেরা এবং রেডিও, গয়না এবং পোশাক একে একে সব কিছু নিয়ে চম্পট দিত। এমনকি  রেফ্রিজারেটরের সব খাবার গিলেও তাদের খাই মিটতো না। অবশেষে ক্যাবিনেট আর বাইরের বারান্দার বার থেকে অবিরাম হুইস্কি সাবাড় করে টরে পাত্তাড়ি গোটাতো।
সিঙ্গল মল্ট (স্কচ হুইস্কি) র জন্য বীমা  কোম্পানিগুলো কোনো ক্ষতিপূরণ দিত না। কত মারাত্মক রকম ক্ষতি করে গেলো বাড়ির মালিকের  একমাত্র তিনিই জানতেন। চোর ব্যাটারা ধারণাও করতে পারবে না কতটা উচ্চমানের হুইস্কি সাবড়ে  গেল তারা।

এমন একটা সময় এলো যে কোনো মানুষকেই আর বিশ্বাস করা যায় না কাজেরলোক বা মালী হিসেবে, কারণ এরা  বেকার ছিল। ত্রিশঙ্কু অবস্থা তখন শহরতলিতে।
লোকগুলো বলতে থাকে, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ  কাজ পারি; আগাছা পরিষ্কার করতে পারি অথবা ছাদ রঙ করবার  জন্য যদি নেন; স্যর, ম্যাডাম,
কিন্তু ভদ্রলোক এবং  তার স্ত্রী সাবধান বানী খেয়াল রাখেন  রাস্তায় কারো সঙ্গে কথা বলা চলবে না। কিছু মাতাল মদ খেয়ে বাতিল বোতল  ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে রাস্তায়।
কয়েকটা ভিখারি অপেক্ষা করে কখন স্বয়ংক্রিয় গেট খুলে ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীর গাড়ি বের হবে। ওরা বসে থাকে জারুল গাছের নিচে,  শুকনো নর্দমায় পা ডুবিয়ে। জারুল গাছের সারি রাস্তার দুধার থেকে হাত বাড়িয়ে লম্বা টানেল তৈরি করেছে এখানে, এই জন্যই এই উপনগরীটি এত সুন্দর। শুধু উটকো লোকগুলোর জন্যই সব নষ্ট হতে বসেছে, কখনো  এরা প্রখর রোদে মাঝ দুপুরে টান টান হয়ে শুয়ে থাকে গেটের ডানদিক ঘেঁষে। ভদ্রমহিলা অবশ্য খিদেয় কাতর কাউকে দেখতে পারেন না। তিনি তার বিশ্বাসী কাজের পরিচারিকাকে দিয়ে চা -রুটি পাঠান। কিন্তু কাজের লোকটি বলে ওরা লোফার,  সন্ত্রাস বাদী। কোনদিন ওরা ওকে বেধে আলমারি তে ঢুকিয়ে রাখবে।
তার স্বামীও এ কথায় সায় দেয়
— ও ঠিকই বলেছে। ওর কথাটা নিয়ে ভাবো।
তুমি শুধু শুধু ওদের চা-রুটি দিয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছ , আর ওরা ওদের সুযোগের অপেক্ষায় আছে।
এরপর থেকে ছেলের ট্রাইসাইকেলটাও রোজ রাত্রে বাগান থেকে তুলে ঘরে নিয়ে রাখা শুরু করলো ওরা। যদিও সব রকম নিরাপত্তার ব্যাবস্থা আছে, তবু  বলা তো যায় না! কখনো এলার্ম সেট লক থাকলে কেউ পাঁচিল বেয়ে স্বয়ংক্রিয় দরজার টপকে যদি উঠে যায়।

— তুমি ঠিক বলেছ,
স্ত্রীও  সহমত হয়। যদিও পাঁচিলটি অনেক উঁচু। আরও উঁচু করা হলো। মহিলার সেই রুগ্ন বুড়ি শাশুড়িটি ক্রিসমাসের উপহার হিসেবে  পাঁচিলে আরও বারতি ইট লাগিয়ে দিলো ছেলে আর তার বউ এর জন্য। বাচ্চা ছেলেটি উপহার পেলো নভশ্চরের সাজ-সরঞ্জাম আর রূপকথার বই।

কিন্তু প্রতি সপ্তাহেই এই নিয়ে কিছু না কিছু অভিযোগ আর কথাবার্তা কানে আসে থাকেই।  প্রশস্ত দিনের বেলায়ই হোক বা ম্রিয়মান রাত্তিরে, সকালের প্রথম আলোই হোক বা নিভে আসা মিষ্টি গ্রীষ্মের নরম গোধূলিতে।



এক পরিবারে রাতের খাবার সময়, ওপরে শোবার ঘর তোলপাড় করে লুটপাট করে নিয়ে গেছে। ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীর মধ্যে আলোচনা চলছিল শহরতলি তে সদ্য হয়ে  যাওয়া এই সশস্ত্র চুরি নিয়ে। হঠাৎ কথার জাল ছিঁড়ে সম্বিত ফিরে পেল যখন ছেলের পোষা বেড়ালটি অনায়াসে সাতফুট উঁচু দেওয়ালটিতে চড়ে বসেছে। নিছক হেলানো তলটিতে খুব দ্রুত  সামনে দুটো থাবার সাহায্যে নেমে এলো প্রথমে, বেশ আরামসেই, লেজটি নাড়াতে নাড়াতে নামল। চুন করা সাদা দেওয়ালে বেড়ালের আসা-যাবার পায়ের ছাপ পড়ে গেলে লক্ষ্য করে দেখা গেল  পাঁচিলের পাশে রাস্তার দিকেও বড় বড় লাল-ধুলোর ধাব্বা। ধাব্বাগুলি মনে হয় ছেঁড়া রানিং সু এর দাগ, যেগুলো বেকার ভবঘুরেগুলোর পায়ে দেখা যায়। সেটা মোটেও কোনো নিরীহ দৃশ্য নয়।

যখন ভদ্রলোক, তার স্ত্রী,  বাচ্চাটি কুকুর নিয়ে ঘুরতে বের হয়। ওরা প্রতিবেশীর বাড়ির রাস্তার দিকে ঘোরে। প্রতিবেশী দের বাগানের দিকটায়  কখনো বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না, প্রশংসিত দৃষ্টিতে তাকায়ও না। গোলাপের বাগান, সুদৃশ্য লন সবই একগাদা সিকিউরিটির বেড়াজালে, যন্ত্রের আড়ালে চলে গেছে। ওরা পার হয় অসাধারণ পছন্দের জায়গাটা। কারো পাঁচিলে  অল্প খরচে, বিকল্প ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছিল পাঁচিলের ওপর সিমেন্ট দিয়ে ভাঙা কাচের টুকরো পুঁতে। কোথাও লোহার পেরেক আর শেষে গজালও পোঁতা হয়েছিল। সেখানে একটা চেষ্টা করা হয়েছিল স্প্যানিশ ভিলা স্টাইলের নন্দনতত্ত্বর সঙ্গে কারাগারের মেলবন্ধন (গজাল গুলো গোলাপি রঙ করা)। কোথাও সিমেন্টের  ঘট বসানো ছিল, বাড়ির সামনের দিকটা গথিক শিল্পের আদলে (সাদা ধবধবে বারো ইঞ্চি লম্বা আঁকাবাঁকা বিদ্যুতের মতো তার জড়ানো , তীক্ষ্ণ বল্লমের ডগা)
কিছু দেওয়ালে ছোট বোর্ড লাগানো ছিল, যারা ডিভাইসগুলো ইন্সটলের দ্বায়িত্বে ছিল সেই ফার্মের ফোন নম্বর আর নাম লেখা।
বাচ্চাছেলেটি এবং পোষা কুকুর এগিয়ে এগিয়ে গেলে, স্বামী এবং স্ত্রী নিজেরাই আবিষ্কার করে এই কায়দাগুলো তুলনামূলক ভাবে দেখতে যতটা, কাজে তত দড় নয়। এবং কিছু সপ্তাহ পরে তারা যখন এই পাঁচিলের সামনে দাঁড়ায়। পরস্পর কোনো কথপোকথন ছাড়াই সিদ্ধান্তে আসে একটা ব্যাপার ভাবতেই হবে । এটা কুৎসিততম কিন্তু খুব ঠিকঠাক,এটা পুরোপুরি কন্সেনট্রেশান ক্যাম্পের আদলে। কোনো বাড়তি সৌন্দর্য্য নয়, কিন্তু কাজের । উঁচু দেওয়ালের ওপর   গোল করে প্যাঁচানো চকচকে মেটালের ব্লেডওয়ালা দীর্ঘ তারকাঁটা। সুতরাং ওপরে ওঠার কোনো উপায় নেই। উপায় নেই তারকাঁটার গোল সুড়ঙ্গতে ঢোকারও, সেখানে ঢুকলে দাঁতের মতো ব্লেডের ফাঁদে না ফেঁসে উপায় থাকবে না। বেরনোর চেষ্টাকরলেই ক্রমাগত রক্তাক্ত হতে হবে। গভীর আর তীক্ষ্ণ কাঁটায় মাংস ছিঁড়ে যাবে। ভাবতেই ভদ্রমহিলা কেঁপে উঠে তাকাল।
— তুমি ঠিক, যে কেউ দুবার ভাববে।
তার স্বামী বলল
এবং ওরা দেওয়ালে আটকানো ছোট বোর্ডের দিকে নজর দিল। “ কনসাল্ট ড্রাগনস টিথ সম্পুর্ণ নিরাপত্তার জন্য।” পরদিনই একদল মিস্ত্রি এসে চারদিকের পাঁচিলের ওপর স্প্রিং এর মতো গোল গোল প্যাঁচানো ধারালো ব্লেডওয়ালা তারকাঁটার রোল জড়িয়ে  দিয়ে গেল, যার ঘেরাটোপে এরপর থেকে ভদ্রলোক, তার স্ত্রী আর বাচ্চাটি পোষা কুকুর বেড়াল নিয়ে চিরকাল নিশ্চিন্তে থাকবে।
সূর্যের আলো ঝলকাচ্ছিল এবং  টুকরো টুকরো হয়ে জ্বলছিল। তারকাঁটার করাত দাঁতগুলো, কার্নিশের ধারালো ব্লেডে ঘেরা বাড়িটি তখন উজ্জ্বল। স্বামী বলল
— কিছু মনে কোরো না। আবহাওয়ার জন্য এরকম  থাকবে না।
স্ত্রী উত্তর দিল
— তুমি ভুল, ওরা গ্যারান্টি দিয়েছে, এতে মরচে ধরবে না।
তিনি একটু অপেক্ষা করলেন, যতক্ষন না বাচ্চাটি দৌড়ে গেল খেলার জন্য। তারপর বলল
— আশাকরি বেড়ালটি খেয়াল করে চলবে ।  
স্বামী তাকে আশ্বস্ত করলেন
— ভয় নেই সোনা, বেড়াল সবসময় দেখেশুনে লাফ দেয়।  
এটা ঠিকই, এর পর থেকে বেড়ালটি বাচ্চা ছেলেটির বিছানাতেই শোয়। বাগানেই থাকে। সিকিউরিটির জালের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে যাবার ঝুঁকি কখনো  নেওয়ার চেষ্টা করেনি।
এক সন্ধ্যায় মা-টি তার ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিল বাচ্চার ঠাকুমার ক্রিসমাসের উপহার সেই রূপকথার বইটি পড়ে।
পরদিন বাচ্চাটির নিজেরই সেই সাহসী রাজপুত্র হতে সাধ হল, যে সাংঘাতিক ঘন কাঁটাপথ পেরিয়ে প্রাসাদে ঢুকে চুমু খেয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙায়  আর ঘুমন্ত সুন্দরী প্রাণ ফিরে পায়: সে একটি মই টেনে আনে পাঁচিলের গায়ে। সেই ঝকমকে প্যাঁচানো তারকাঁটার সুড়ঙ্গটি ছিল ওর ছোট্ট শরীরটি হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকার মতো চওড়া।প্রথমে সেই তারকাঁটার  দাঁত তার হাটুগুলোয় ফুটলো, তার পর হাতে, মাথায়, সে যত ছাড়ানোর চেষ্টা করে আরও জট পাকিয়ে যায়। বিশ্বস্ত কাজের লোকটি আর ঠিকা মালি যার সেদিন হাজিরার দিন ছিল, দৌড়ে আসে, প্রথমে ওরাই দেখে, ওর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। ঠিকা মালিটি কাঁদতে কাঁদতে বের করার চেষ্টায় নিজের হাত ক্ষতবিক্ষত  করে ফেলে। ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী জান্তব চিৎকারে ফেটে পরে, এই সময়ই হঠাৎ কী কারণে আলার্মগুলো বেজে ওঠে (সম্ভবত বেড়ালের জন্যই)। সমস্ত আলার্মগুলো ওদের চিৎকারের বিপরীতে বেজে যাচ্ছিল। তার কাটার যন্ত্র, ছুরি, করাত নিয়ে ভদ্রলোক তার স্ত্রী, হিস্টিরিয়াগ্রস্থ বিশ্বস্ত কাজের মেয়েটি, ক্রন্দনরত মালিটি —যখন বাচ্চাটিকে সিকিউরিটির প্যাঁচালো হাঁ এর মাঝখান থেকে উদ্ধার করে ক্ষতবিক্ষত-রক্তাক্ত  অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছিল বাড়ির ভেতরে।

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে