টোমাজ ট্রান্সট্রোমার এর কবিতা
ভূমিকা ও অনুবাদ – সৌম্য দাশগুপ্ত
টোমাজ ট্রান্সট্রোমার (১৫
এপ্রিল, ১৯৩১ – ২৬ মার্চ, ২০১৫) সুইডেন তথা
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রধানতম কবি ও অনুবাদক, যাঁর লেখা সুইডেনে তো বটেই, এমনকি সারা পৃথিবীতে
গভীর প্রভাব ফেলেছে। (টমাস নয়, টোমাজ, কারণ খ্রিষ্টীয় রীতিতে এ-দুটি এক-ই নাম হলেও
ওঁরা টোমাজ-ই বলেন।) ২০১১ সালে তিনি নোবেল পেলেন। তার পাওয়ার এক বছর আগে, ২০১০
সালে কবিসম্মেলন পত্রিকার শারদ সংখ্যার জন্য তাঁর একগুচ্ছ কবিতার অনুবাদ করার সুযোগ
হয়েছিল আমার। নোবেল পাওয়ার পর হাওয়াকল প্রকাশনী ট্রান্সট্রোমার এর পূর্ণাঙ্গ একটি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশের ভাবনা
জানালেন। ২০১২ সালে বেরিয়েও গেল সেই বই। সম্প্রতি, কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদিত আবহমান পত্রিকার জন্য ভূমিকাসহ
এর কিছু কবিতার পুনর্মুদ্রণ করতে চাইলেন।
সুইডিশ ভাষা আমার জানা নেই,
ইংরেজি রূপান্তর থেকে এগুলি বাংলায় অনুবাদ করা। সুইডিশ থেকে ট্রান্সট্রোমারের
ইংরেজি রূপান্তর যারা করেছেন, তাঁদের মধ্যে আমেরিকান কবি রবার্ট ব্লাই আমার
পূর্বপরিচিত, পোয়েট্রি পত্রিকার শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আরেকটি অনুবাদ প্রকল্পে তাঁর
সঙ্গে যোগাযোগ হয়। রবার্ট নিজে প্রচুর অনুবাদ করেন এবং সেটা অসম্ভব নিষ্ঠার সঙ্গে,
সেজন্য তাঁর নিজের কবিতাই হোক বা অন্যের-ই হোক, তাঁর সাড়া পেয়েছি।
ট্রান্সট্রোমারের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করে আমার অনুবাদের কথা জানান, উত্তর আসে তাঁর স্ত্রী মনিকার কাছ থেকে। ট্রান্সট্রোমার
নিজে ১৯৯০ সাল থেকে স্ট্রোকে পঙ্গু, তাই তাঁর স্ত্রী-ই যোগাযোগের দায়িত্বে।
টোমাজের ই-মেল ঠিকানা মনিকা জানালে আমি সেখানে ই-মেল-ও দিই, কিন্তু ফের মনিকাই
উত্তর দেন এই অনুবাদের ব্যাপারে তাঁদের এজেন্ট গুস্তাফ বন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করার
পরামর্শ দিয়ে। আমি গুস্তাফকে বিস্তারিত
জানাই এই অনুবাদ পরিকল্পনার কথা, কিন্তু আজ অব্দি তাঁর উত্তর পাইনি। সম্ভবত বাংলার
বাজার থেকে সম্ভাব্য রয়াল্টি সম্পর্কে তাঁদের উচ্চাশা নেই।
টোমাজের কবিতাগুলি পড়ার সময়
যেসব অনুষঙ্গ জানা থাকলে বিদেশী পাঠকের সুবিধে হয়, সেগুলির মধ্যে একটা হল সুইডেনের
আবহাওয়া ও ঋতুবৈচিত্র্য। পাশ্চাত্যের বহু দেশের মতোই সুইডেনে চারটি ঋতু – শীত,
বসন্ত, গ্রীষ্ম, আর হেমন্ত। হেমন্তকে ‘ফল’ বলা হয় আমেরিকায়, প্রধানত এই সময়টা
পাতাঝরার কাল বলে, যদিও ‘অটাম’ও বলেন অনেকে, যেমন আছে টোমাজের জীবনীতে। অটাম বা
‘ফল সীজন’ শব্দগুচ্ছের প্রয়োগ আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশে ‘কেজো’, কারণ
এইসময় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন শুরু হয়, নতুন বছরের তোড়জোড় সাধারণত অগাস্ট
থেকে সেপ্টেম্বরেই হয়। বাংলায় হেমন্ত শব্দটা যতটা কাব্যিক লাগে ইংরেজি বা সুইডিশে অটাম ততটা কাব্যিক
প্রয়োগ নয়। ট্রান্সট্রোমার
বেশ কয়েকবার তাঁর স্মৃতিকথায় অটাম শব্দটা ব্যবহার করেন, তাই এই ব্যাখ্যাটা দিতে
হল। এই ঋতুগুলি এসব দেশের বাসিন্দাদের মুডের ওপর খুব প্রভাব ফেলে। খানিকটা আঁচ পাওয়া যাবে এই বইয়ের শেষে অনুবাদ
করা টোমাজের জীবন স্মৃতিতে, যেখানে তাঁর শিক্ষক বোকেন সাহেবের পড়ানোর মুড নির্ভর
করত বাইরের আবহাওয়ার ওপর। কাজের সূত্রে
আমাকে সুইডেনে বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছে। শীতের সময় প্রায় গোটা দিনটাই অন্ধকার
পেয়েছি স্টকহোমে এমন হয়েছে। আবার গ্রীষ্মের সময় রাত দুটোয় একটু সূর্য ডুবে গিয়েই
তিনটের মধ্যে ঘরভরা রোদ্দুর পেয়েছি। উত্তর আমেরিকার কয়েকটা জায়গায় হয়ত স্টকহোমের
থেকে বেশি-ই বরফ পড়ে, কিন্তু ওই দীর্ঘ, দীর্ঘকাল ব্যাপী অন্ধকার, ঠান্ডা, আর বরফের
এই জেরে একধরণের বিষাদে এইসব জায়গার অনেকে আচ্ছন্ন থাকেন। ট্রান্সট্রোমারের কবিতায়
এই আলো-অন্ধকার, ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে মুড পরিবর্তনের ব্যাপারটা বারবার এসেছে।
দ্বিতীয় ব্যাপারটি হল তাঁর
প্রগাঢ় সঙ্গীতবোধ। রবার্ট ব্লাই তাঁর
লেখায় আমাদের জানান যে ট্রান্সট্রোমারকে বুঝতে হলে তাঁর সাংগীতিক দিকটার কথাও
ব্জানতে হবে। তাঁর বহু কবিতায় আছে এক গভীর সঙ্গীতচেতনার পরিচয়। সরাসরি রেফারেন্স টানলে
ত কথাই নেই, কিন্তু অন্তর্গত এক ধরণের ছন্দ আর সুর ইংরেজি অনুবাদগুলি পড়ার সময়েও
কানে এসে পৌঁছচ্ছিল যেন, সেগুলি বাংলায় কি আমাদের মতো করে ধরা যায় ? জানিনা। হয়ত
এই অনুবাদে মূল কবিতার অনেকটাই ‘বাদ’ হয়ে গেল!
তৃতীয়ত, ট্রান্সট্রোমার একজন
মনস্তাত্বিক ডাক্তার। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে মন¯তত্ব নিয়ে পাশ করে ট্রান্সট্রোমার নিয়মিত মনস্তত্ব চর্চা করতেন। তাঁর স্মৃতিকথা
পড়লেই দেখতে পাই তিনি কেমন দক্ষ মনস্তাত্ত্বিকের মতো নিজের স্মৃতি খুঁড়ে নানা
মণিমুক্তো বের করছেন, নানাভাবে তার বিচার বিশ্লেষণ করছেন, আর তাঁর কবিজনোচিত
ভাষ্যে সেই বিশ্লেষণ কেমন বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে। স্মৃতিকথাটি সতন্ত্রভাবেই অতি
সুপাঠ্য, তাঁর জীবনও বিচিত্র, কিন্তু আরো একটি কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ – তাঁর
কবিতাকে ধরতে সাহায্য করে এই লেখাটি। কবিতাগুলির শেষে ট্রান্সট্রোমারের সেই
আত্মজীবনীও তাই অনুবাদ করলাম এই আশায়, যে সেটি তাঁর কবিতার জগত ও কবিচেতনার গঠনের
ব্যাপারে অত্যন্ত অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। এত মায়াময় জীবনকথা, কিন্তু বলেছেন কেমন
অনায়াস স্মার্ট ভঙ্গিতে, সূক্ষ্ম রসবোধের আলগা প্রকাশে। এই জীবনস্মৃতিটি পড়লে আমার
এই শৃঙ্খলিত অনুবাদের অসার্থক দিকগুলি খুলে যেতে পারে বলে আমার আশা।
মাত্র তের বছর বয়সে কবিতা
লেখা শুরু করেন, এবং ১৯৫৪ সালেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সতেরোটি কবিতা’ প্রকাশ করেন। ২০০৪ সালে তাঁর
সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ ‘দেন স্তারা গাতান’ (জমাট রহস্য’) প্রকাশিত
হয়। এটি হাইকু স্টাইলে লেখা ছোট ছোট
কবিতার সমষ্টি। মোট আটটি বই তাঁর, প্রত্যেকটি-ই হ্রস্ব।
অন্যান্য কবিরা - যাঁরা
রাজনৈতিক সত্তরের দশকের কবি, তাঁরা
ট্রান্সট্রোমারকে ট্রাডিশনের বাইরে মনে করতেন, এবং তাঁর
লেখায় রাজনৈতিক ইস্যু না থাকার সমালোচনা করতেন। কিন্তু তাঁর কাজ মডার্নিস্ট আর
এক্সপ্রেশনিস্ট/সুররিয়ালিস্ট ভাষায় বিশ শতকের কাব্যভাবনায় তৈরি। তাঁর পরিষ্কার,
সহজ ও সরল দৈনন্দিনের জীবন থেকে নেওয়া ছবিগুলি মানবমনের বিশ্বভাবনায়
রহস্যময় অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরে।
ইমেজ-এর অদ্ভূত ব্যবহার তাঁর,
অনায়াসে তাঁর কবিতায় ইমেজ উঠে আসে। রবার্ট ব্লাই লেখেন, ‘তাঁর কবিতাগুলি যেন এক
আশ্চর্য রেলওয়ে স্টেশন, যেখানে বহুদূর থেকে আসা কিছু ট্রেন কিছুক্ষনের জন্য
পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে, একটার ক্যারেজের তলায় রাশিয়ার বরফ লেগে আছে, আরেকটার
কম্পারটমেন্ট থেকে ভেসে আসছে ভূমধ্যসাগরপারের ফুলের সুগন্ধ, তৃতীয় আরেকটার ছাতে
রূঢ়ের কালি। কবিতাগুলি রহস্যময়, কারণ ইমেজ
গুলি বহুদূর থেকে ভ্রমণ করে এসেছে সেখানে। মালারমে বলতেন যেমন, বাস্তবের সঙ্গে
কবিতার যদি বেশি যোগসূত্র এসে যায়, তাহলে কবির উচিত সেই সূত্রগুলি ছেঁটে ফেলা,
তাহলে রহস্য বজায় থাকে। ট্রান্সট্রোমারের কবিতায় বাস্তবের সঙ্গে যোগসূত্র কেমন
জেদের সঙ্গেই আছে, কিন্তু তাতে রহস্য আর মায়া কোথাও হারিয়ে যায় না’।
১৯৯০ সালে একটি মারাত্মক
স্ট্রোকে ট্রান্সট্রোমারের বাকশক্তি ব্যাহত হয়, কিন্তু
তিনি লিখে চলেছিলেন তারপরও। বেশ কয়েকবার
তাঁকে সাহিত্যের নোবেল প্রাইজের যোগ্য প্রতিনিধি হিশেবে পেশ করা হয়েছিল। লেখক সত্ত্বা ছাড়াও তিনি একজন শ্রদ্ধেয় মনস্তত্ত্ববিদ্
ছিলেন স্ট্রোকের আগে। অল্পবয়সী ছেলেদের জেলখানায় সময় কাটিয়েছেন, পঙ্গু, ড্রাগসেবনকারী,
ও আসামীদের সঙ্গে থেকেছেন। ভালো পিয়ানোও বাজাতেন, স্ট্রোকের পরেও যা তিনি চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তবে
এক হাতে। তাতেই এত দক্ষতার সঙ্গে তিনি বাজান যে সুইডিশ কম্পোজাররা বাঁ হাতে
বাজানোর জন্য বিশেষ কম্পোজিশন তৈরি করে পাঠান তাঁর জন্য। এতে সুইডেনের মানুষের
হৃদয়ে ট্রান্সট্রোমারের স্থানটা কোথায় তা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না।
অনুবাদের কাজ পাশ্চাত্যে একটা
কর্মযজ্ঞ। প্রায়শই টিমওয়ার্কে কাজটা সম্পন্ন হয় – কেুউ কবি, কেউ সমাজবিজ্ঞানী, কেউ
আবার সেই কবির ওপর গবেষণা করেই দিন গুজরান করেন। এত যত্ন করে কাজ করেন যারা,
তাঁদের বহু পরিশ্রমের ফল নিয়ে একা বসে বাংলায় অনুবাদ করে দিলাম, এতে দুর্বলতা
থাকবেই। কয়েকজন বন্ধু সাহায্য করেছেন বহুমূল্য মন্তব্য করে, এমনকি সম্পাদনার কাজেও
সাহায্য পেয়েছি সেই কবি বন্ধুদের। তাঁরা হলেন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সন্দীপন
চক্রবরতী, ও গৌতম চৌধুরী। এঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এর দুর্বলতার দায়িত্ব আমার-ই, আর ভুল যদি করে
থাকি তা হবে কবির প্রতি অবিচার, তার তো
কোনো ক্ষমা নেই।
সন্ধে-সকাল
চাঁদ-মাস্তুলে পচন ধরেছে, পালগুলো গেছে কুঁচকে
গাংচিলটিও মত্ত, নৌকো
ভাসিয়ে চলেছে সাগরে -
আধপোড়া লাগে ডকের পৃথুল ঘনকের এক টুকরো
ওঁত পেতে থাকা জন্তুর মতো ঝোপে নেমে এল সন্ধে
দোরগোড়া জুড়ে থেকে থেকে যেন ধাক্কা দিচ্ছে সূর্য
সমুদ্রের ওই রুপপাথরের গেট ভেদ করে ঝলকায়
রোদ্দুর, যেন পৃথিবীর
খুব কাছে; সাগরের
কুয়াশায়
শ্বাস রোধ হওয়া গ্রীষ্মের যত দেবতারা শুধু হাতড়ান।
ঝড়
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সেই বুড়োর সঙ্গে দেখা -
একটা দৈত্যসমান ওক গাছের
যেন পাথর হয়ে যাওয়া হরিণ
বিরাট শাখাময় শিং নিয়ে ঠেলছে হেমন্ত-সমুদ্রের
ঘনসবুজ দুর্গদেয়াল
উত্তরের ঝড়। রোয়ানফল পাকার সময় হয়ে এল।
রাতে জেগে সে শোনে একমনে
ওক গাছের মাথার অনেক ওপরে
নিজের নিজের আস্তাবলের ভিতরে
তারাপুঞ্জের খুরের
আওয়াজ ।
অর্ধ-সমাপ্ত স্বর্গ
ভীরুতা নিজের পথ খুঁজে নিয়ে চলে
বিষাদ নিজের পথ খুঁজে নিয়ে চলে
শকুন নিজের পথ খুঁজে উড়ে যায়।
আগ্রহী আলো ঝলমল খুলে যায়
মদিরাপাত্র তুলে নেয় অশরীরী।
বাতাস
দেখছে আমাদের ছবিগুলি
তুষারযুগের স্টুডিওর লাল পশু।
সবকিছুরই তো মোড় ফিরে এল তবে
দল বেঁধে তবে রোদ্দুরে চলো যাই।
প্রতিটি মানুষ যেন অর্ধেক খোলা
দরজার মতো, যেন তারা
কোনো ঘরে
রাস্তা দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে যায়।
পায়ের তলায় শেষহীন প্রাšতর।
গাছ, ফাঁকে ফাঁকে জল চিকচিক করে।
এই লেক যেন জানালা এ-পৃথিবীর।
বইয়ের
আলমারি
তার মৃত্যুর পর ওটা ফ্ল্যাটের বাইরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।
বেশ কয়েকদিন ফাঁকা থাকার পর ওটার তাকে বই রাখা শুরু করলাম, কাপড়ে বাঁধাই করা ভারী ভারী বই। এসবের ফাঁকে কোনোভাবে আমারই অনবধানে ঢুকে পড়েছে খানিকটা
কবরের মাটি। অতলের থেকে কিছু একটা উঠে এসেছিল, ধীরে
ধীরে উঁচু হয়ে সেটা দুর্দম, প্রকান্ড এক পারদস্তম্ভ হয়ে দাঁড়ালো। মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।
মুখবন্ধ ঘনরঙ সেই
ভল্যূমগুলি দেখতে ঠিক সেই আলজিরীয় মুখগুলির মতো, যাদের দেখেছিলাম সীমান্তে,
ফ্রীডরিখ-স্ট্রাসের ওপর, পূর্ব
জার্মানির পুলিশের সীলমোহর পাওয়ার জন্যে লাইন দিয়ে অপেক্ষায়। কাচের ঘরটায় আমার
নিজের পাশবই-ও দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিল।
বার্লিনে সেদিন যে সান্ধ্য বাতাস দেখেছিলাম, ঠিক সে বাতাস যেন বইয়ের এ আলমারিটায়।
এর মধ্যে আছে একধরণের প্রাচীন নিরাশা,, যার স্বাদ অনেকটা
প্যাশেনডেল[1] আর
ভার্সাইয়ের শান্তিচুক্তির মতো, কিংবা হয়ত আরো পুরোনো। ওই বিশাল বইগুলির দিকে বারবার ঘুরেফিরে আসি - ওগুলো
নিজেরাই যেন একেকটা পাসপোর্ট। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষকে এত এত সরকারি স্ট্যাম্প
লাগাতে হয়েছে যে ভারী হয়ে গেছে বইগুলি। স্বভাবতই, মানুষ তো
আর তার মালামাল কখনোই যথেষ্ট পরিমাণে অনুমান করতে পারে না। এই যে সেগুলি চলে যেতে
শুরু করেছে, এই যে অবশেষে তুমিও ...
প্রবীণ ঐতিহাসিকেরা সবাই
আছেন সেখানে, তাঁরা উঠে দাঁড়িয়ে উঁকি মারতে পারেন আমাদের
পারিবারিক জীবনে। কিছুই শোনা যাচ্ছে না যদিও, তবু কাচের
ওপাশে তাঁদের ঠোঁটগুলি সর্বক্ষণ ফিসফিস করছে (‘প্যাশেনডেল’[2]...)। ব্যাপারটা
প্রাচীন একটা অফিসবাড়ির গল্প মনে করিয়ে দেয়, ( একেবারে ভুতুড়ে গপ্পো), যে-বাড়িতে বহুকাল ধরে মৃত
সব ভদ্রলোকদের ছবি টাঙিয়ে রাখা থাকতো, আর একদিন অফিসকর্মীরা খেয়াল করলো যে ফটোফ্রেমের কাচের
ভিতরের দিকটা ভিজে ভিজে। যেন মৃতেরা রাত্রিবেলা শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলা শুরু করেছিল।
বইয়ের আলমারিটা এর চেয়ে অনেক পোক্ত। এক নম্বর এলাকা থেকে
পাশের এলাকায় সিধে তাকিয়ে থাকে! এমন চকচকে
ত্বক, যেন অন্ধকার নদীর ত্বকের মতন, যার ওপর এই
ঘর তার নিজের চেহারা দেখবে। আর মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া বারণ।
অনন্ত
অন্দরমহল
বসন্ত এল ১৮২৭-এর
বীটহোভেন তাঁর মৃত্যু-মুখোশ তুলে
পাল তুলে দেন জলযাত্রায়
পাড়ি ।
শানপাথরের ঘূর্ণনে ইউরোপের
হাওয়াকলগুলি ঘোরে, বুনোহাঁসগুলি
দল বেঁধে সব উড়ে চলে উত্তরে
এই তবে হলো উত্তরদিক, আর
এই হলো তার কিনারায় স্টকহোম
গিজগিজ করে প্রাসাদ ও ঘরবাড়ি
রাজপ্রাসাদের ফায়ারপ্লেসের গুঁড়ি
সাবধান থেকে বিশ্রামে ভেঙে পড়ে
প্রতিষেধক ও আলু ভরা সংসারে
শান্তি বিরাজ করে, তবু নগরের
কুয়োগুলি সব নিঃশ্বাস ফেলে ভারী
রাতের আঁধারে আরামচেয়ারে ঢাকা
পাশার মতন গোপন ব্যারেলগুলি
আস্তে আস্তে পার হয় নর্থব্রিজ
নুড়িপাথরের ঢাক্কায় টাল খায়
ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা, লোফার,
অদম্য এক নিথর নামের ফলকে
ধূমপানরত কৃষ্ণাঙ্গের ছবি
এত দ্বীপ, এত ক্রমাগত বেয়ে চলা
অদৃশ্য দাঁড়ে,
স্রোতের উল্টোদিকে!
একে একে খোলে নদীর প্রণালীগুলি
এপ্রিল-মে, জুন মাস মধুকরী
দ্বীপদ্বীপান্তে পৌঁছয় গ্রীষ্মের
ওম, গ্রামে গ্রামে খুলে যায় সব দোর
কেবল একটা দরজা বন্ধ থাকে।
নীরবতা চাটে সাপ-ঘড়িটার কাঁটা
ভূ-তত্ত্বের ধৈর্যে আরক্তিম
উপত্যকায় পাথরের মৃদু ঢাল
অনেকটা ঠিক এরকম গল্পটা –
পারিবারিক এক আবছা কাহিনী হবে
এরিককে নিয়ে, অভিশাপ লেগে যার
বিকলাঙ্গের দশা,
আত্মাকে তার
বুলেটের দাঁত করেছে অন্ধকার।
শহরে গিয়ে সে শত্রু বানালো এক
ঘরে ফিরলো সে পঙ্গু, ফ্যাকাশে হয়ে
সারাটা গ্রীষ্ম বিছানায় শুয়ে থাকে
দেয়ালে টাঙানো কল-কব্জারা শোকে
সে থাকে জাগর, শোনে রাত্রির মথ
ডানা ঝাপটায়, জ্যোৎস্নার কমরেড।
জোর কমে আসে, ব্যর্থ ধাক্কা দেয়া
লৌহকঠিন অনড় আগামীকাল।
আর গহনের দেবতারা ডাকে তাকে
গহনে গহনে, ‘আমাদের ত্রাণ ক’রে
সে-পুণ্যে তবে নিজেকে মুক্ত করো!’
বাইরের যত ক্রিয়াকাজ, তারা সব
ভিতরের দিকে ওগরায় উত্তাপ
ছিঁড়েখুঁড়ে খায় তাকে, ফের দেয় জোড়া
হাওয়া ওঠে, আর বুনো গোলাপের ঝাড়
শরীরে তাদের পড়ন্ত আলো ধরে
খুলে যায় তার ভবিষ্যৎ, সে চোখে
তুলে নেয় তার ঘোরানো ক্যালিডোস্কোপ
দ্যাখে আবছায়া কাঁপাকাঁপা মুখগুলি
বংশের ধারা, এখনো আসেনি যারা
ভুল করে তার নজর লাগলো আমার-ই
শরীরে, যখন হাঁটছি ওয়াশিংটনের
জমকালো সব ঘরবাড়িদের ফাঁকে
প্রতি দুটি থামে ধরা থাকে যত ভার।
শাদা বাড়িগুলি যেন ক্রিমাটোরিয়াম
দুর্ভাগাদের স্বপ্ন পোড়ায় তারা
উপত্যকার মৃদু ঢাল
হয় খাড়া
অতর্কিতে সে অতল গহ্বর যেন!
[2] ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত প্যাশেনডেল আক্রমণ হয়েছিল, যেখানে ইংরেজ বাহিনী বেলজিয়ামের কাছে ইপ্রেস অঞ্চলে অল্প কিছু এলাকা দখলের
জন্য জর্মান বাহিনীকে আক্রমণ করে, প্রচুর হতাহতের পর জেতে, কিন্তু এই নিয়ে আজও ঐতিহাসিকেরা বিতর্ক করে থাকেন। কেউ বলেন, সামান্য জমির জন্য এত হতাহতের কোনো অর্থ নেই, কেউ বলেন যে জমি সামান্য হলেও মিত্রবাহিনীর মনের জোর এতে খুব বেড়ে
গিয়েছিল।
সৌম্যর অনুবাদ সদা-ঈর্ষাজাগানিয়া। আরও সময় দিতে পারত যদি ও অনুবাদে, কত হিরেজহরত এসে জড়ো হত বাংলায়...
ReplyDelete