Thursday, October 11, 2018

বেবী সাউয়ের ছয় মহলা বাড়ি নিয়ে আলোচনা - কুন্তল মুখোপাধ্যায়







বেবী সাউয়ের ছয়মহলা বাড়ি : একটি নিবিড় আত্ম-উন্মোচন

গ্রন্থ- ছয় মহলা বাড়ি / বেবি সাঊ / ভাষালিপি / ১২০ .০০ /প্রচ্ছদ – সঞ্জীব চৌধুরী

দ্বিতীয়বার পড়ার আহ্বান আছে বইটিতে । আমাদের মনের মতো রহস্যময় এই বই । কবিতা লিখতে গিয়ে তো নিজেকেও জানতে চান কেউ কেউ ; অনেকেই বুঝতে চান বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংঘাতে তিনি নিজে কেমন হয়ে ওঠেন , নিজেকে চিনে নেওয়ার এ এক আশ্চর্য উপায় । সত্যিকারের মানুষের কাছে , মানে সত্যিই যার দৃষ্টিশক্তি রয়েছে এমন মানুষের কাছে , নিজের অন্ধকার আর আলোময় ভিতরমহল এক আত্মরতিমুগ্ধ স্বয়ংবিশ্ব । যেখানে পরতে পরতে খুলে যাই নিজেই , নিজেকে এই যে দেখতে পাওয়া , নিজের এই যে অভাবিত রূপ খুঁজে পাওয়া এ কিন্তু শাশ্বত , চিরকালের । এই বইটিতে তাই দ্বিতীয়বার ঝাঁপ দেওয়ার আগে নিজের দিকে তাকিয়ে নিতে হয় । 

কবি রনজিত দাশের একটি কবিতায় পড়েছি যে বোকাদের জন্য কোনও কবিতা লেখা হয় না । যে ঠাড় বোঝে না ইশারা বোঝে না , তার পক্ষে কিসসু করা সম্ভব না । এই বই কিন্তু সাজিয়ে রেখেছে অনন্ত ইশারা । অবিরত এই ইশারার পৃথিবীতে কখনও নিজের মধ্যে দাঁড়িয়ে যায় অসংখ্য আয়না , কখনও কোনও দিনলিপির অভিঘাত বেজে উঠতে চায় । শুধু বেজে ওঠাই লক্ষ্য হয়ে ওঠে তার । অনেক রকম কবিতা পড়তে পড়তে কোনও পাঠকের মনে হতেই পারে যে কবিতা সবসময় ভিন্ন আঙ্গিকের পরিবেশন নয় । সবসময় সে নয় চমক অথবা নিবিড় আত্ম-উন্মোচন । সে কখনও প্রতিদিন , প্রতিদিনের যাপনও । এই বইটিতে যাপন এসে যায় । তবু সেই যাপন দিয়ে যায় এক শাশ্বত ঢেউয়ের ছাট , লবনাক্ত সমুদ্রের ইশারা ।

ছয়খানা মহল নিয়ে ঘর । মূলাধার , স্বাধিষ্ঠান , মণিপুর , অনাহত , বিশুদ্ধ , আজ্ঞা । আর সবশেষে উপসংহার । ঘর নয় বাড়ি । ঘর হলে একটা লোকজ দর্শন আর ভাবনা পাওয়া যেত । কিন্তু বাড়ি বলে এর নাগরিকতা স্পষ্ট হয়ে যায় । পর্বগুলির নামকরণে তন্ত্রানুসঙ্গ স্পষ্ট । ‘ কুণ্ডলিনী সেই বিস্তারিত সাপ / শীতগুচ্ছ ভেঙে / ঘামের বিচ্ছেদ শেখে / আরও পিচ্ছিল হয় যাতায়াত / গানের রেওয়াজ / তারপর সাদা শুধু সাদা / তুলোটের ভোর যেন টটকো নদীধারে / নিজেকে ছড়ায় / শুভ্র হাঁস-বনে ’ একটা ক্রম-উত্তরণ স্পষ্ট । একটা সিদ্ধির দিকে হেঁটে যাওয়া ।এই সিদ্ধির কথা আছে হিন্দু শাস্ত্রে ও দর্শনে ।

আরও একটু তলিয়ে দেখলে মনে হয় কবিতাও তো একধরণের ধ্যানই । কখনও সে গৃহকোণের ছবি দেখায় , কখনও বা নিজের , কখনও সন্ধ্যার ছবি , দীর্ঘ ছায়া ও শরীর পেরিয়ে স্থির ভাস্কর্যে হেঁটে আসছেন সেলুকাস কখনও বা হৃদয়ফলক । বিশুদ্ধ পর্বে কয়েকটি ছবির নির্মাণ পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে কিছুক্ষণ । তার মধ্যে অবশ্যই একটি হল ‘বিশুদ্ধ স্বরবর্ণের মতো’ মা আর শিশুর ছবি । দুবার জান্নাত শব্দটি এসেছে কবির কলমে , এই পর্বে । এই শব্দটির ব্যবহার কোনও প্রচলিত ধর্ম থেকে পাঠককে নিয়ে  যায় দূরে । কাজেই পাঠকের মনে হতে থাকে এখানে তন্ত্রের একটা সাবজেক্টইভ আউটলুক এখানে রয়েছে । আর সেটা কখনই কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের পরিসরের মধ্যে নয় । বিস্ময় এইখানে যে কবি এই শব্দটি খুব সুচিন্তিতভাবে রেখেছেন বিশুদ্ধ পর্বে । বিশুদ্ধতার একটা অন্য সীমানা তৈরি করে দিলেন ।

যেখানে উৎসবের আতিশয্যে অনেক কবিই ভুলে যান, নিজেকে ও নিজের ভাষাকে বারবার আক্রমণ না করলে একটি নির্দিষ্ট ভাষা ও ভাবনায় আবদ্ধ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে, যা ক্রমশ তাঁদের এক অভ্যস্ত কবিতাযাপনের কাছেই নিয়ে যায়, পাঠকদেরও আশ্বস্ত করে এক চেনা পরিসরের মধ্যেই ঘুরপাক খাওয়ার জন্য, সেখানে এই কাব্যদর্শন এক আশার মতোই।



ফিরে আসছে পুনরাবৃত্তিরা। পায়ে পায়ে বিদায় উচ্চারণ করছে হেঁটে যাওয়া রোদ্দুর। আর একঝাঁক ধূসর ঘুঘু, স্মৃতিভূমি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মুহূর্তেরা কিলবিল আনন্দে পান করছে বিষাদের রস। রাগে কাঁপতে কাঁপতে গুমরে উঠছে সাঁঝবেলার শাঁখ। কীভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে তোমার গোলাপসুন্দরীর কথা! যাকে তুমি উপহার দিতে সক্ষম ছিলে সাঁঝতারা। আমার হাসিতে তখন এক নীরব আস্তরণ, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি হচ্ছে আশ্চর্য বুনট আর ক্ষত সৃষ্টিকারী এক অব্যর্থ দাওয়াই ।

তখনই , চাঁদে ঝলসে উঠলো গাছ , শুকনো মাঠে বসল প্রেমের আসর । আর ত্রিশটা গৃহযুদ্ধ একপাতে বসলো আনন্দভোজনে ...


আরও একটি ভাবনার কথা বলা যায়, আর তা হল, একধরনের সিগনেচার ভাষা, যা এক বিশিষ্ট কবিকে 'বিশিষ্ট' করে। আমরা বুঝতে পারি, তাঁর কাব্যব্যক্তিত্বকে। বেবীর কবিতার অভিযাত্রার বৈশিষ্ট্য হল, এই কবির ব্যক্তিত্ব বা পারসোনার সিগনেচার তিনি ভাষায় রাখছেন, কিন্তু কাঠামোয় রাখছেন না। গান লেখে লালনদুহিতায় যেমন তিনি সনেটের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন তাঁর অন্তর্জগতের যাপনকে, তেমন ছয় মহলা বাড়ি শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তিনি এক বিশেষ দর্শন ও ক্রিয়ার রূপকে প্রকাশ করেছেন তাঁর জীবন ও মনোজগতের আধ্যাত্মিক জার্নিকেই।

সমগ্র বইটি মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, আজ্ঞা, মণিপুরম, অনাহত, বিশুদ্ধ, উপসংহার- এই ছটি পর্বে বিভক্ত। প্রতি পর্বে ছটি করে কবিতা আছে। সমগ্র কবিতার বইটি যেন এক অভিযাত্রার বর্ণনা।

যেমন

সাঁকোতে লেগে থাকা হাঁটাপথ-- হড়ের জল স্রোত ভাঙছে। কতদিনের এই অ-ধোয়া দেহ, অগুরু চন্দন; আচমনের নামে পেতে রাখে জলধারা। কোষে কোষে সমুদ্র গুঞ্জরিত হয় মৃদুস্বরে। জন্মদিন এসে নামে ধীরে। খেসারি-খিচুড়িতে পাত পেতে বসে মধ্যদুপুর। গাল-গল্প শেষে সেও মৎস্যকথা শোনে। কোলাহল শেষে ঘুমায়।  নিশ্চিন্তে।

ছয় মহলা বাড়ি কাব্যগ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য এখানেই, যে তা, বহিরঙ্গে এক আধ্যাত্মিক ক্রিয়া হলেও, অন্তরঙ্গে, নানান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাকৃতিক অনুষঙ্গে রচিত হওয়া এক কবির মানসিক আধ্যাত্মিক সংযোগ সাধন। 'যোগ' ও 'সংযোগ'- এই দুই ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে প্রকৃতির লীলার ক্ষেত্রগুলি কাজ করে চলে। ছয় মহলা বাড়ি সেই লীলাগুলিকেই বারবার তুলে ধরেছে আপাত গদ্য কিন্তু ছন্দময় গদ্যে লেখা, মিথ, প্রতীক, আবহমান দৃশ্যকল্প ও বোধির স্পর্শে নতুন করে দেখা দৃশ্যকল্পের সঙ্গীতের মাধ্যমে। বাউল, বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক দর্শনের পারস্পরিকতার সঙ্গে মিলে মিশে গেছে সহজিয়া ও মরমীয়া বাকভঙ্গি। আধ্যাত্মিক ক্রিয়া ও আধ্যাত্মিক ভিশন মিলে মিশে গেছে তাঁর আপাত স্থির কিন্তু অন্তরে চঞ্চল কবিতাগুলির মধ্যে। প্রতিটি কবিতা যেন সামুদ্রিক ঢেউ, যা অপর একটি ঢেউয়ের জন্ম দিয়ে প্রবহমান রেখেছে স্রোতটিকে।

এই চর্চার বিভিন্ন মহল তথা বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে কবি নিজে তাঁর কাব্যিক অভিযাত্রাটিকে হাজির করছেন এমন এক বিমূর্ত চর্চার দোরগোড়ায়, সেখানে সম্ভবত আর কোনও মহল নেই, চরম শূন্যতা ছাড়া। রূপ থেকে অরূপে যাচ্ছেন তিনি, আমাদের অখণ্ড চৈতন্যের অনন্তকালীন অস্তিত্বের মতো।



কবি যেহেতু নারী তাই আজ্ঞা অংশে এসে একটু খটকা লেগে যায় । শিবের রূপ আর বাকপ্রতিমার প্রয়োগ লক্ষ্য করি । ধাঁধা লেগে যায় কবির মানসপ্রতিমা ঠিক সাজাতে পারা  যায় না । আর ঠিক তখনই এই বইয়ের অন্য পর্বের আর একটি কবিতা পাশে এসে দাঁড়ায় “ অথচ তুমি আছ --- তুমি নেই / আমি আছি অথচ আমি নেই / সমস্ত জানার পরে ভাতের গন্ধ ভাসছে / দূরে চইচই ফিরছে হাঁসের দল / ...”  ভাবতে পারি যে এই বইয়ের কবি অস্তিত্ত্বের একটা সমগ্রতায় পৌঁছাতে চাইছেন । কিন্তু সেটা চিরপরিচিত বাঁধাবুলির মধ্যে দিয়ে নয় । একটা মানবের দৃষ্টি লাভ করতে চাইছেন ।

ছয় মহলা বাড়ির বারান্দা থেকে আদি অনন্তকাল আর বর্তমান দেখে নিতে চাইছেন , বুঝে নিতে চাইছেন জীবন আর তার অন্তর্গত রহস্যময়তা ।           

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে