Sunday, October 14, 2018

জগন্নাথ-স্তোত্র / শ্রীচৈতন্য (অনুবাদ – তন্ময় ভট্টাচার্য)







জগন্নাথ-স্তোত্র / শ্রীচৈতন্য





কালিন্দী নদীর তীরে, বনের ভেতরে
গান শুনে যাঁর মন এককালে নেচে উঠেছিল
মৌমাছির মতো যিনি গোয়ালার মেয়ে-বৌদের
মুখের নরম স্বাদ মিটিমিটি কুড়িয়েছিলেন
এবং লক্ষ্মী, শিব, ব্রহ্মা প্রমুখ সাকারেরা
যাঁর পায়ে পুজো দিয়ে উৎফুল্ল, বিভোর
তিনি, সে-জগন্নাথ, আমার চোখের সামনে
চোখের পথের সামনে আসুন এবার

বাঁ-হাতে বাঁশিটি ধরে, মাথায় নীল পালক গুঁজে
কোমরে হলুদ ধুতি জড়িয়ে-পেঁচিয়ে
বন্ধু রাখালদের দিকেও আড়ের চোখে
             যিনি প্রায়ই ধারালো তাকান
সেই কোনকাল থেকে বৃন্দাবনে বসে-বসে
             লীলা করে দিন কাটে যাঁর
তিনি, সে-জগন্নাথ, আমার চোখের সামনে
চোখের পথের সামনে আসুন এবার

বিশাল সমুদ্র-ঘেঁষে, সোনারং পাহাড়চূড়োয়
প্রাসাদে সেঁধিয়ে যিনি বলরাম-সুভদ্রার মাঝখানটিতে
নিজের জায়গা করে নিয়েছেন; আহা কী দয়ালু -
সমস্ত দেবতাদের সুযোগ দিচ্ছেন যাতে
              সেবা-টেবা ঠিকঠাক হয়
তিনি, সে-জগন্নাথ, আমার চোখের সামনে
চোখের পথের সামনে আসুন এবার

দয়ার ফুরান নাই, দেখতেও মেঘেরই মতন
যে-সে মেঘ নয়, ভারী, টলোমল জলের আধার
লক্ষ্মী-সরস্বতী দুই নারীকে বাঁদিকে নিয়ে
                দিব্যি কাটছে দিন যাঁর
এমনকি বেদেও
যাঁর চরিত্রের কথা গুণ হিসেবেই পাওয়া যায়
তিনি, সে-জগন্নাথ, আমার চোখের সামনে
চোখের পথের সামনে আসুন এবার

ধরা যাক, রথে চেপে যাচ্ছেন কোথাও
অমনি ব্রাহ্মণেরা মাঝপথে ধরে যাঁকে
              স্তব-টব শোনাতে থাকেন
আর বেশ খুশি-খুশি মুখ হয় যাঁর;
সমুদ্র-কে দয়া করে পাড়টিতে থিতু হয়ে যান -
তিনি, সে-জগন্নাথ, আমার চোখের সামনে
চোখের পথের সামনে আসুন এবার

যদিও স্তবের ক্ষেত্রে নিরাকার; শরীরী দশায়
যাঁর চোখ মৌজ হয় পদ্মের মতন
পাহাড়-শেষের শূন্যে পা রেখে কাটানো দিনগুলোয়
যাঁর ফূর্তি বেড়ে যায়
        রাধার রসালো দেহ ছুঁয়ে
                     ও জাপটে ধরে, সুখে -
তিনি, সে-জগন্নাথ, আমার চোখের সামনে
চোখের পথের সামনে আসুন এবার

রাজ্য চাই না আমি; সোনাদানা, প্রাচুর্যও নয়
সকলে কামনা করে, লাল ফেলে, এমন মাখন
                মেয়ে-টেয়েও চাই না মোটেই
বরং, যুগান্ত ধরে স্বয়ং পাগলা-শিব
                যাঁর কথা ছড়িয়ে বেড়ান
তিনি, সে-জগন্নাথ, আমার চোখের সামনে
চোখের পথের সামনে আসুন এবার

আমার সংসার নাও
সাড়হীন এই সংসার
আমার যা-কিছু পাপ - নিয়ে নাও, নিয়ে নাও সব
যার কেউ নেই আর দেওয়ার মতোও সব শেষ
           তাকে যিনি চুপিচুপি জড়িয়ে রাখেন -
তুমি সে, জগন্নাথ, আমার চোখের সামনে
চোখের পথের সামনে ঘনাও এবার


কৈফিয়ৎই বটে! নইলে শুধু অনুবাদ করেই ক্ষান্ত হওয়া যেত। কিন্তু এই কথাগুলো না বললে পাঠকের কিছু ধোঁয়াশা থেকে যেতে পারে। আসলে, চৈতন্যদেব যে বেশ কিছু শ্লোক লিখেছিলেন, তা জানা গেলেও লিখিত কোনো হদিশ পাওয়া যায় না সে-সবের। এই জগন্নাথ-স্তোত্র ছাড়া আরও ছুটকো-ছাটকা কিছু শ্লোক আছে, যেগুলির কয়েকটি কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’-তে সংকলিত করেছিলেন, আর কয়েকটি কবিতা রূপ গোস্বামী তাঁর সংকলনে চৈতন্যদেবের রচিত বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে, চৈতন্যদেবের রচিত লেখাগুলির মধ্যে, সম্ভবত এই জগন্নাথ-স্তোত্রই দীর্ঘতম।

জানি না, এর আগে কেউ এ-স্তোত্রের বাংলায় পদ্যানুবাদ করেছেন কিনা। করলেও, এমন রোয়াব নিয়ে নয় নিশ্চয়ই। এবার, নিজের অনুবাদের সমর্থনে কিছু কথা বলি। চৈতন্যদেব সংস্কৃতে যে-আট স্তবকের স্তোত্র লিখেছিলেন, তা ভক্তিরসে টইটম্বুর। জগন্নাথের সঙ্গে ক্ষণে-ক্ষণে কৃষ্ণের তুলনা করে(সেটাই স্বাভাবিক, কেননা কৃষ্ণেরই আরেক রূপ জগন্নাথ) প্রকৃতপক্ষে নিজের হৃদয়ের অর্ঘ্যই অর্পণ করেছিলেন তিনি। আর, ভক্তি অন্ধ হওয়ায়, অনেককিছুই ভগবানের লীলাহিসেবে সহজ হয়ে গেছে। হোক, তাতে দোষ নেই। ভক্তির লক্ষণই ওই। এখন বিষয় হচ্ছে, অনুবাদ করার সময় আমিও কি ভক্তির সেই স্পন্দন ধরেই এগিয়ে যাব? আপাত-উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। নইলে মূল ভাব ফুটিয়ে তুলব কী করে! কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, আমি সে-পথ মাড়াইনি। চৈতন্যদেবের রচনায় যা জগন্নাথের মহিমা হয়ে উঠেছে, জাগতিক চোখে আমি সে-ঘটনাগুলোকে বাস্তবের আয়নাতেই ফেলেছি। এবং অবাক হয়ে দেখেছি, আমার ও-দুষ্কর্মের ফলে অলংকার ও মহিমা ঝরে গিয়ে উঠে এসেছে দৈনন্দিনতা। যেন জগন্নাথ ঈশ্বর-টিশ্বর নন, আমার বন্ধু কোনো। হ্যাঁ, বন্ধুত্বে নামিয়ে আনতে না পারলে এ-অনুবাদে হাত দিতাম না আমি। অহেতুক ভক্তি প্রচার করা আমার উদ্দেশ্য নয়; অন্তত সেক্ষেত্রে তো বটেই, যেখানে ভাবান্ধ হয়ে বেশ কিছু সুবিধাবাদী প্রবণতাকেও ঐশ্বরিক বলে চালিয়েছেন চৈতন্যদেব।

তাহলে কী ছাতার মাথা অনুবাদ করলাম আমি! আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ তো নয়ই! বরং একে আভাসের অনুবাদ বলা যেতে পারে। আমি চৈতন্যদেবের থেকে রসদ নিয়েছি, এবং আমার মতো করে জগন্নাথকে ফুটিয়ে তুলেছি। এখানে জগন্নাথ যেন এক কেউকেটা, চারপাশের লোকজন তেল দিচ্ছে দেখলে তৃপ্তও হন। এর আগে লীলায়-লীলায় বাংলা সাহিত্যকে ভরিয়ে দিয়ে গেছেন পদকর্তারা। কাজেই সে-দায় আমার নেই। ভক্তি-গদগদ ভাব থেকে সরে আসায়, এবং মূল সংস্কৃত থেকে অন্য ভাষায় লাফ দেওয়ার কারণেও, রুক্ষ হতে পারে অনুবাদ। স্বীকার করে নিলাম। চৈতন্যদেব রচিত জেনেও অনুবাদ করার সময় সাবধান হইনি মোটেই। সে-ব্যাপারে সচেতন হয়ে গেলে ইস্‌, চৈতন্য-বয়ানে এমন লিখছি!ভেবে লজ্জা পেতে হত। চৈতন্যদেব তাঁর পথে চলুন, আমি আমার।

প্রসঙ্গত, একটা কথা জানিয়ে রাখি। এ-স্তোত্রের আটটি স্তবকের মধ্যে থেকে চারটি, ছোটবেলা থেকেই আমার কণ্ঠস্থ। খোদ সংস্কৃতে। এবং, মানে বুঝেই। ফলে, হঠাৎ হাতে পেলাম আর যা-হোক অনুবাদ করে ছেড়ে দিলাম, ব্যাপারটা এমন নয়। মূল আটটি স্তবকের প্রতি স্তবকে একজোড়া শ্লোক রয়েছে, অর্থাৎ স্তবক প্রতি মোট চারটি চরণ। আমি অনুবাদে সেসবের ধার ধারিনি। ওই চার চরণকে প্রয়োজনমতো বাড়িয়েছি-কমিয়েছি নিজের লেখায়। আর, পাঠক, খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, আটটির মধ্যে প্রথম ছটি স্তবকেই কমবেশি জগন্নাথ ও তাঁর লীলার বর্ণনা। ফলে, সে-জায়গায় আগল ভেঙেছি ইচ্ছেমতো। কিন্তু শেষ দুটি স্তবকে, বিশেষ করে শেষটিতে, চৈতন্যদেব যখন উত্তম পুরুষে নেমে এলেন, সে-অংশের সৌন্দর্য অস্বীকার করার মানে নিজের বোধের মৃত্যু স্বীকার করে নেওয়া। সমস্ত স্তোত্রের আসল সৌন্দর্য বোধহয় লুকিয়ে আছে শেষ স্তবকটিতেই। যেখানে স্তব ছেড়ে চৈতন্যদেব সমর্পণ করছেন নিজেকে। শোনো, তুমি তো জগন্নাথ, আমার দায়িত্ব নাও। আমি আর কিছু জানি না। জানতে চাইও না। এতক্ষণ অনেক কথা বলেছি, অনেক ভালোয় ভরিয়েছি। এবার মিশিয়ে নাও। আমরণ ভাসাও আমাকে।

এই সমর্পণই সব পূজার, সব ভালোবাসার শেষ কথা। বাদবাকি হারালে হারাক। এটুকু যেন থেকে যায়...


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে