Saturday, October 13, 2018

মার্গারেট অ্যাটউড (ভাষান্তরঃ অনিন্দিতা গুপ্ত রায় )






ফাঁসুড়ে কে বিয়ে

মেয়েটিকে ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। একজন পুরুষ ফাঁসি এড়াতে পারে যদি সে নিজেই ফাঁসুড়ে বনে যায়, নারীটি পারে ফাঁসুড়েকে তাকে বিয়ে করতে রাজী  হলে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনও ফাঁসুড়ে নেই; তাই কোনও মুক্তিও না। শুধু একটি মৃত্যু আছে, অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত। এটা কোনও কাল্পনিক ঘটনা নয়, এটা ইতিহাস।
######
জেলখানায় বাস করা মানে আয়নাবিহীন বসবাস। আয়না ছাড়া বসবাস মানে নিজের সত্ত্বাটিকে ছাড়া বসবাস। তাই মেয়েটি অনস্তিত্ব হয়েই বেঁচে আছে। সে  পাথরের দেওয়ালে খুঁজে পেয়েছে একটা ফুটো আর দেওয়ালের অন্য পাশে, একটা কণ্ঠস্বর। অন্ধকারের ভিতর থেকে সেই স্বর ভেসে আসে যার কোনও মুখ নেই। সেই স্বর তার আয়না হয়ে ওঠে।
#####
নিজের মৃত্যু থেকে বাঁচতে, মটকানো ঘাড় আর ফুলে ওঠা জিভ নিয়ে নির্ধারিত মৃত্যুটি থেকে, মেয়েটিকে ফাঁসুড়েকে বিয়ে করতেই হবে। কিন্তু কোনও ফাঁসুড়েই নেই, প্রথমে তাকে লোকটিকে সৃষ্টি করতে হবে, ঐ কণ্ঠস্বরের আড়ালে থাকা লোকটিকেই তাকে পটাতে হবে, সেই স্বর যাকে সে কখনো দেখেনি অথবা যে  তাকেও , এ এক অন্ধকার, সে তাকে রাজি করাবেই যাতে সে নিজের মুখটিকেই ছুঁড়ে ফেলবে, মৃত্যুর নৈর্বক্তিক মুখোশের সঙ্গে বদলাবদলি করে নেবে, সেই ঘোষিত মৃত্যুর সাথে যার শুধু দুখানা চোখ আছে কিন্তু মুখগহবর নেই, সেই অন্ধকার  কুষ্ঠরোগীর মুখোশটির সঙ্গে। তাকে বদলে দিতে হবেই লোকটির দুটি হাত, যে হাত উৎসুক হয়ে উঠবে কণ্ঠনালীর চারপাশে ফাঁসির দড়ি জড়িয়ে দিতে, যেমনটি তার সঙ্গে হওয়ার কথা, তবু তার নয়, অন্য অন্য গলাগুলির আশেপাশে। সে তারপর সেই ফাঁসুড়েকে বিয়ে করবে, অন্য কাউকে নয়। ব্যাপারটা খুব খারাপ কিছুও নয়, বিয়ে করার জন্যই বা আর কে আছে?
####
তুমি অবাক হয়ে ভাবছ তার অপরাধ টা কী। সে তার মালিকের পোশাক চুরি করার দোষে মৃত্যুদন্ড পেয়েছে। মালিকের স্ত্রীর পোশাক চুরির অপরাধে। মেয়েটি  নিজেকে আরো একটু সুন্দর দেখাতে চেয়েছিল। চাকরবাকরদের এই আকাংক্ষা মোটেই আইনসিদ্ধ নয়।
####
মেয়েটি নিজের গলার স্বরকে হাতের মত ব্যবহার করল, তার আওয়াজ দেওয়াল ভেদ করে গেল, ছোট্ট ছোট্ট ধাক্কায়, স্পর্শ করতে করতে। সে এমন কী বলতে পারে যাতে লোকটির বিশ্বাস জন্মাবে? সে তো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নয়, তার জন্য অপেক্ষায়  আছে মুক্তি। কোন প্ররোচনা কাজে লাগতে পারে?  হয়তো লোকটি চাইছিল এমন একজন নারীর সঙ্গে বাঁচতে যার জীবন সে নিজে বাঁচিয়েছে, যে মাটির গভীরে সেঁধিয়ে যেতে যেতেও যেকোনভাবে তাকে অনুসরণ করেই ফিরে এসেছে। এটা তার নায়ক হওয়ার একমাত্র সুযোগ ছিল, অন্ততঃ একজন মানুষের কাছে, এই কারনেই, সমস্ত পৃথিবী তাকে ঘৃণা করলেও সে ফাঁসুড়ে হয়েছে। লোকটি জেলখানায় এসেছিল অন্য একজনকে আহত করে, ডানহাতের একটি আঙুলে, তলোয়ার দিয়ে। এটাও ইতিহাস।
####
বন্ধুরা, যারা নিজেরাও নারী, আমায় তাদের গল্প বলে, যেগুলো অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি। সেসব ভয়ের গল্প এবং সেগুলো  আমার জীবনে ঘটেনি, এখনো ঘটেনি, ঘটেছে কিন্তু আমি নিজেকে তা থেকে সরাতে পেরেছি, আমরা ভয়ে ভয়ে নিজেদের না-বিশ্বাস লক্ষ করতে থাকি । আমাদের সঙ্গে এমন কখনো হতেই পারেনা, এখন  তো বিকেলবেলা আর বিকেলে এসব ঘটনা ঘটেনা। সমস্যা হল, মেয়েটি বলেছিল, আমি আমার চশমা চোখে দেওয়ারও সময়  পাইনি আর চশমা ছাড়া আমি বাদুড়ের মতই অন্ধ, কে ঘটনাটা ঘটিয়েছে সেটাও আমি দেখতে পাইনি। এসবই হতে থাকে আর আমরা টেবিলের পাশে বসে তাদের নিয়ে গল্প করি যাতে শেষ অবধি আমরা কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারি। এসব কাল্পনিক নয়, এসব ইতিহাস, আসলে ফাঁসুড়ে একাধিক আর সেই কারনেই তাদের কজন কর্মহীন
#####
লোকটি বলেছিলঃ  দেওয়ালের শেষপ্রান্ত, রজ্জুর শেষপ্রান্ত, দরজার খোলা মুখ, একটি মাঠ, বাতাস, একটা বাড়ি, সূর্য, একটা টেবিল, একটি আপেল।
মেয়েটি বলেছিলঃ স্তনবৃন্ত, বাহু, ঠোঁট, সুরা, পেট, কেশ, পাঁউরুটি, উরু, চোখ।
তারা দুজনেই তাদের কথা রেখেছিল।
####
ফাঁসুড়ে ততটা খারাপ লোক নয়। এরপর সে তার রেফ্রিজারেটারের কাছে গেল আর বাসী খাবার গুলো সাফ করল, যদিও হাত ফসকে পড়ে যাওয়া ঝোলটুকু সে মুছলো না। সে শুধু সাধারণ জিনিসপত্র চায়ঃ একটা চেয়ার, তার জুতো খুলে দেওয়ার মত  কেউ একজন, যখন সে কথা বলবে তাকে লক্ষ্য করার মত একজন কেউ, শ্রদ্ধায় ভয়ে আর সম্ভব হলে কৃতজ্ঞতায়, কেউ একজন যার মধ্যে সে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলতে পারে বিশ্রাম অথবা জেগে ওঠার জন্য। আর এর জন্য সবচেয়ে ভালো হল  একজন মেয়েকে বিয়ে করে ফেলা যে কিনা সুন্দর হবার আকাঙ্ক্ষায় অন্য পুরুষের কাছে শাস্তিপ্রাপ্ত। বেছে নেওয়ার কত কিছুই আছে।  
প্রত্যেকেই বলেছিল লোকটি খুব বোকা।
প্রত্যেকেই বলেছিল মেয়েটি খুব চালাক।
ওরা “ফাঁদে ফেলা” কথাটা ব্যবহার করেছিল।
#####
ওরা কী কথা বলেছিল যখন প্রথম এক ঘরে একা মুখোমুখি হল দুজনে? ছেলেটি কী বলেছিল যখন মেয়েটি প্রথম তার ঘোমটা সরালে সে দেখেছিল শুধুমাত্র কন্ঠস্বর নয়, মেয়েটি একটি শরীর আর সেটি পরিমেয়। মেয়েটি কী বলেছিল যখন সে আবিস্কার করেছিল একটি তালাবন্ধ ঘরের জন্যই পরিত্যাগ করে এসেছে আরেকটি বন্ধ ঘর? স্বভাবতই তারা ভালোবাসার কথা বলেছিল, যদিও তা চিরকাল তাদের ব্যস্ত রাখে নি।  
#####
সত্যিটা হল এইই যে আসলে বন্ধুদের বলার মত আমার কাছে এমন কোন গল্প নেই যা তাদের আরেকটু ভালো থাকার বোধ দিতে পারে। ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। যদিও সে বিষয়ে কল্পনা করে আমরা নিজেদের শান্ত করতে পারি। সে সময় কোনও মহিলা ফাঁসুড়ে ছিলনা। সম্ভবত কখনোই এমন কেউ ছিলনা, আর তাই কোনও পুরুষ তাকে বিয়ে করে নিজের প্রাণ বাঁচাতেও পারত না। যদিও একজন  মহিলা তা পারত, আইন অনুযায়ী।
####
ছেলেটি বলেছিলঃ পায়ের পাতা, জুতো, আদেশ, শহর, মুষ্ঠি, রাস্তা, সময়, ছুরি
মেয়েটি বলেছিলঃ জল, রাত্রি, উইলো, দড়ির তন্তু, পৃথিবীর গর্ভ, গুহা, মাংস, শবাচ্ছদন, উন্মুক্ত, রক্ত।
তারা দুজনেই তাদের শপথ রেখেছিল।
( অষ্টাদশ শতাব্দীর কোয়েবেক এ মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্তর মৃত্যু এড়াবার ক্ষেত্রে পুরুষের একমাত্র উপায় ছিল ফাঁসুড়ে বনে যাওয়া আর একটি মেয়ের  ছিল সেই ফাঁসুড়েকে বিবাহ করে মৃত্যু এড়ানোর পথ। ফাঁসোয়া ল্যরেঁ , চুরির অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল। সে পাশের কক্ষে থাকা জঁ কোরোলিরে’কে রাজি করায়  ফাঁসুড়ের শূন্য পদে আবেদন করতে ও তাকে বিবাহ করতে)।
কবি পরিচিতি ঃ মার্গারেট অ্যাটউড

বিতর্কিত, বহুল চর্চিত ও প্রভুত জনপ্রিয় মার্গারেট অ্যাটউড  (জন্ম, ১৮ই নভেম্বর, ১৯৩৯) একজন কানাডিয়ান কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, আবিষ্কারক, পরিবেশ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে  রয়েছে সতেরোটি কবিতার বই, ষোলটি উপন্যাস, দশটি গদ্য গ্রন্থ, আটটি ছোটগল্প সংকলন, আটটি ছোটদের জন্য লেখা বই, একটি গ্রাফিক নভেল ও অসংখ্য ছোটবড় সাহিত্যকীর্তি। ম্যান বুকার , আর্থার সি ক্লার্ক এওয়ার্ড, গভর্ণর জেনারেল এওয়ার্ড, ইউএসএ ন্যাশনাল এওয়ার্ড সহ অজস্র সম্মানে ভূষিত ৭৮ বছরের মার্গারেট এর লেখায় পরিবেশ সমাজ লিঙ্গ বৈষম্য ক্ষমতার রাজনীতি ইত্যাদির সঙ্গে রূপকথা ও উপকথার মিশ্রণ ও নিজস্ব কন্ঠস্বর তাঁকে অনন্যতা দিয়েছে।   


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে