Saturday, October 13, 2018

ব্যাঞ্জো প্যাটারসন ( অনুবাদ- শুভদীপ নায়ক)





বনভূমির গায়ক

স্নিগ্ধ বাতাসেই  ঘাসেরা তরঙ্গায়িত
বাতাসের গানে 
গুনগুন শব্দে কয়েকহাজার মাছি
পরিশ্রম করে চলেছে সমস্তদিকে
কেননা সেখানে আছে পুষ্পমুকুলের ঘ্রাণ
বৃক্ষের বৃহৎ ডালে 
এবং বসন্তের নিঃশ্বাসে
যেন ললাটেই তার নরম চুম্বন
এমনই বসন্তে, --- আমি গাইছি

সেখানেই অনাবৃষ্টি মাটির ওপরে গাছে গাছে
পথ ধরে গড়িয়ে চলেছে
টলমলে মেষপাল
বুরুশের ন্যায় কুঠার নিয়ে 
যেভাবে বেঁচে থাকা সৃষ্টি হয়
কুঠার চালিয়ে
নিয়তির সঙ্গে যুদ্ধ করে, বাঁচার তাগিদে 
আমি সেই যুদ্ধে,--- গান গাইছি 



ত্রিমুখী
(A triolet)

কবিতার সব অসুস্থ আকৃতিগুলি
আমাকে আদেশ করে ত্রিমুখির দিকে
যদি তারা আমাকে আরও বীভৎস কবি করে তোলে
আমি খুঁজে পাব কবিতার আরও অসুস্থ দিক
আমি নেমে যাব অভিশপ্ত পাঠকের মনে
হয়ে যাব শব্দের ক্ষীণতম মিল
খুঁজে পাব কবিতার যাবতীয় অসুস্থ দিক
যেগুলো আদেশ করে আমাকে ত্রিমুখির দিকে



তোমার দু'চোখ যতটা নীলাভ
(As Long as your Eyes are Blue )

তুমি কি তখনও আমায় ভালবাসবে যখন আমার চুলগুলো ধূসরাভ হবে
আর আমার সমস্ত গাল হারাবে তার হলুদ চিকণতা
যখন আমার যৌবনের সব প্রভা চলে যাবে
তোমার প্রেম কি তখনও প্রমাণ করবে তার বার্ধক্যের সত্যতা


যদি মুখবয়ব বদলে যায়, হৃৎকম্পন থেমে যায়
কোথাও আর খুঁজে না পাই ভালবাসাকে
তোমার প্রেম কি ফিরিয়ে আনবে যৌবনের সব সত্যিগুলোকে 
এতগুলো বছর পরেও 

আহা ! তোমাকে ভালবাসি তোমার এই বাদামি চুলের বন্দীত্বে
এবং তোমার গালের মিথ্যে গোলাপি আভাটুকু
আমি ভালবাসি হৃদ্যতার জন্য
কেননা তোমার দু'জোখের নীলে আমি দেখি সবকিছু

কারণ, চোখই চিহ্ন সমস্ত মনকেমনের
আর হৃদয়ের যা কিছু সত্য
তাই নিয়ে আমি তোমাকে ভালবাসি, হে প্রিয়তমা
শুধু তোমার দু'চোখ যতটা নীলাভ


কেশ যদি শ্বেতবর্ণ হয়ে আসে, ত্বক যদি ভরে ওঠে শ্যামলিমায়
তাকে তুমি আশ্রয় দিও তোমার সোনালি আভায়
হে প্রিয়তমা ! তবু আমি ভালবাসব তোমায়
তোমার দু'চোখ যতই হয়ে উঠুক নীলাভ



চলন্ত  
( Moving on)

এই যুদ্ধের মধ্যে আমরা চলেছি 
ক্রমশ চলেছি 
যখন এক বন্ধুকে কাছে পাই আমরা 
হারাই অন্যকে
মেয়েদের সুহৃদ মুখে
আমাদের জন্য পড়ে থাকে স্থান
তাদের চটি-জুতোর কাছে  প্রভূত পুরুষেরা
তলিয়ে চলে
যেভাবে মানুষ যায় হাসপাতালের দিকে
চূড়ান্ত সাহসিকতার সঙ্গে
সেইসব পুরুষেরা হয়ে ওঠে পশ্চিমের অস্তগামী
আর তখনই তোমার শ্বাসরোধী কান্না নেমে আসে
ক্রমশ চলেছি আমরা তারই ভিতর




তেমনটা নয়
(Not on it)

নতুন অন্তরঙ্গ বন্ধু এই টাট্টু ঘোড়াটির খেলা ছিল চমৎকার
তার মালিক তাকে যত পিছনে টানে, সে ততই অগ্রজ
পাঁচটি বইয়ের মধ্যে একটি বই যেমন প্রচলিত ধারণার বাইরে লেখা হয়
তেমনই ঘন্টার ধ্বনি বাজলে, ছোট্ট অশ্বটি বেরিয়ে আসত 
তার সব প্রচেষ্টা নিয়ে বন্ধনী ছিঁড়ে 
'কী আশ্চর্য, রোবো ! ' ধীর পায়ে যেন এসেছে আমাদের নায়ক হয়ে
লোকেরা তার ভেল্কি দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে কাঁদত
হে প্রভু ! তুমিও কি ছিলে ক্রন্দনরত
তাকে দেখতাম তার নোয়ানো পতাকার মধ্যে দিয়ে
তার ভাগ্য দ্রুত বলত---
ছোট্ট ঘোড়াটিকে যেন দেওয়া হয় ওর সব বসন্ত ফিরিয়ে
অশ্বারোহীকে দেওয়া হোক সরিয়ে 
খেলা শেষ হলে, নায়কের মতো
তবু সে জাগ্রত হয়ে থাকত



বৃদ্ধ মানুষ প্লাটিপাস 
(Old man platypus)


দুর্গতি থেকে দূরে শহরের কঠোর পরিশ্রমে
যেখানে নলখাগড়ার বিছানা ভেঙে ফ্যালে ঝাঁট দিয়ে
বাদামি মোলায়েমের মতো সেখানে টুকরো হয়ে থাকে
ঝোঁকের মধ্যে এই বৃদ্ধ মানুষ প্লাটিপাস
নদীর সব ঝঞ্ঝা পেরিয়ে


সে তখন নদীর বাঁক নিয়ে খেলা করে
ডুবে যায় নিজস্ব ভঙ্গিতে, সে পালায়
তার সব বন্ধু সম্পর্কের ভিতর থেকে
পালায় প্রকাশ্যে তার পরিবার থেকে


নদীর বাঁকের প্রতিটি গর্ত ঘূর্ণি সে এনে দেয়
তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে
আর এনে দেয় সেই নলখাগড়ার শিকড়, ঘাসপাতা
কিন্তু জলের প্রতিটি বুদ্বুদ জানে সে কীভাবে ভেসেছে
কীভাবে তলিয়ে গেছে অতলে 


ঝর্ণার নীচে তার খননগর্তগুলো নিরাপত্তা পায়
তারা সকলে বাঁচে যেন এক সুন্দর পৃথিবীতে
যেখানে কেউ আসবে না, কেউ ডাকবে না
তারা একটি ব্রিলিয়ার্ড বলের মতো ঘুমাবে সেখানে

এবং সেইসব কথা সে বিড়বিড় করে বলে চলে 
তার সমস্ত যাত্রা হয়ে ওঠে নির্জন, একাকী
কিন্তু মোরগ বা মাছের সঙ্গে কখনও তার সম্পর্ক হয় না 
হয় না পাখির সঙ্গে, ক্ষুধার্ত পশুর সঙ্গে কিংবা হিংস্র পেঁচার সঙ্গে
কেননা, সে শুধু নিভৃত, চিরএকাকী




উপকূলবর্তী সূর্যদয়
(Sunrise on the Coast)

বালির পাহাড়ে ধূসরাভ ভোর যেন রাতের বাতাসে ঝুকিপূর্ণ
সমস্ত রাত জুড়ে বয়ে আনে সাগরের ঘ্রাণ
ধূসর ভোরের এই কুয়াশা তাদের সঙ্গীদের ছেড়ে গেছে
তার সব প্রভাতের ডাকে ছড়িয়ে পড়েছে উড়ে উড়ে 
এবং মাথার অনেক ওপর দিয়ে ভাসমান নরম নিদ্রা
গড়িয়ে চলেছেঢ়সব সামুদ্রিক জীবদের দল
তাদের বারণ কোরো না ঘুমের ভিতর নক্ষত্র দেখতে

ঠিক পূর্বদিকে যেখানে বিরাট আকাশ বিশ্রাম নিচ্ছে 
সমুদ্ররেখা বরাবর রাতের মশারির মতো উত্তেজিত
যা আসলে আচ্ছাদিত দিগন্ত থেকে দূরে 
ঈশ্বরের স্বর সেখানে ফিরে এসে বলে আলো জ্বালো

এবং আলো জ্বলে সেখানে ! মৃদু ক্ষণস্থায়ী
লাল পদ্মরাগমণির মতো ধূসর সংকুচিত
বেগুনি উজ্জ্বল লোহিতবর্ণ সোনালি প্রভার মতো
স্থির থাকি, মনে হয় যেন আশ্চর্য ব্যাপার, কোনও এক দিনের জন্ম



পরীর চুম্বন
(The angel's kiss)

বিছানার পাশে তবু দাঁড়িয়ে পরীটি
যেখানে শায়িত জীব এবং মরাটি
সে তার মায়ের প্রতি মৃত্যুতেই ঋদ্ধ
চুম্বনে চুম্বনে যীশু যেন ক্রুশবিদ্ধ

আত্মাকে শুভেচ্ছা দেয়, কেননা সে ক্লান্ত
যখন দুর্বল সে, আসলে উদ্-ভ্রান্ত

যুগ্ম দুটি চুমু দেয় সে তার শিশুকে
বুকের ওপর একটি, অন্যটি মস্তকে

সে বলল, পৃথিবীর কাছাকাছি চলো
মন বুদ্ধিকে তাই শুভেচ্ছা পাঠালো 

ঈশ্বরের জন্য যে প্রাণ ধার্মিক হবে
সেও তো আদেশ করে নিজেকে বর্তাবে

সে জন্মে মায়ের প্রেম বঞ্চিত করেছে
আমি তাকে তুলে আনি, যেন সে মরেছে

মায়ের জীবনটুকু আসলে বোঝেনি
দেবী হতে চেয়ে যেন নিজেকে খোঁজেনি

চুম্বন, প্রার্থনা হল মন কিংবা বুদ্ধি
যা আসলে আত্মার কথন বা বিশুদ্ধি

শৈশব চলেছে যেন আলোর অন্দরে
ডানার পরীরা নামে কোন্ বন্দরে

কিন্তু মানুষের বহতা কবরগুলো
চুমু আর আশা ভরা নিরাময় ধুলো
সকলে তো পরী, মায়ের মতন ভুলো



মূল্যহীন নির্বাচক
(The Free Selector)


হ্যাঁ, শিল্পের সন্তান, তোমাকেই বলছি
তুমি সঙ্গীত সৃষ্টি করতে পার
জন রবার্টসনের মতো জয়ের গান
জমি বিল পাস হয়ে গেছে, সুসময় আগত

আর আমাদের ঘুরতে হবে না ইতঃস্তত
গৃহের জন্যে জিগ্যেস করতে হবে না কাউকে
আমাদের জমি এখন শৃঙ্খলমুক্ত, আমরা তার পাশে
খানিকটা জলের ধারে গড়ে নেব নিজস্ব বসতি

কিছুটা জমিতে থাকবে উর্বরতা যা হবে নিজের
যা শুধু হরিৎবর্ণ হবে, আমরা ঘর তুলব সেখানে
আমাদের শিল্প ফলাবে বিকাশে হাসি
আমাদের শিশুরা বেছে নেবে পরিশ্রম সততা

গাছে ভরে যাবে আমাদের বাগান, শস্য ফলবে ক্ষেতে
সেই ফল খেয়ে বাঁচ আমরা যা শিল্প আমাদের দেবে
এবং তা স্বাধীনভাবে, দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে
আর তবেই হবে জীবনের দীর্ঘায়ু 



সমতল
(The plains)

একটি জমি, যতদূর চোখ যায় ঘাসের তরঙ্গ
অথবা সমান তল, পোড়া, কালো, মিথ্যার আভাস
আশার চিহ্ন  পাল্টাচ্ছে জমিটিতে, --- তুমি কিছুই জানছ না 

জমি আসলে চায় ধূসর নাচের নর্তকী
আশা কিংবা ভয়ের, সকল সুযোগের
কিন্তু প্রকৃতি বিচলিত, সে বিমূঢ়, রক্তাক্ত মিলনে উদ্-গ্রীব

আমরা কি সেই রূপকথার গান শুনতে পাই , বাতাসের সমস্ত চলাচলে
অথবা সবুজের পেকে ওঠা বা ঝরে পড়া শুষ্কতার গন্ধ কি পাই
যখন ঝড় এসে জমিটিকে ভেঙে দেয়, হাড় ভাঙার মতো তার মিথ্যের দুর্গকে





No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে