Saturday, October 13, 2018

ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতা- (অনুবাদ- শ্রীজাতা গুপ্ত)





১৮৯৮ সালে গ্রানাডা, স্পেনের এক বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কবি, নাট্যকার ফেডেরিকো গারসিয়া লোরকা। গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনার পর ১৯১৯ সালে লোরকা মাদ্রিদ শহরে পাড়ি দেন, লেখালেখিতে আরও মনোনিবেশ করবেন বলে।
নতুন শহরে তাঁর বন্ধুত্ব হয় সালভাদোর দালি এবং লুই বুনুয়েল এবং নতুন ধারার আরও অনেক শিল্পীর সঙ্গে। 'জেনারেশন ২৭' নামে এই শিল্পী-দলের মাধ্যমে লোরকা প্রথম সারিয়ালিসম এর ধারণার সঙ্গে পরিচিত হ'ন, যা ক্রমে তাঁর লেখার উপর প্রভাবে ফেলতে শুরু করে। 
প্রেম, বিরহ-এর পাশাপাশি স্পেইনের লোককথা আর লোকগানের প্রভাব, যাযাবর সংস্কৃতি তাঁর লেখাকে প্রভাবিত করেছে বরাবর।
 
১৯২৮ সালে নিউ ইয়র্ক ভ্রমণের সময় আফ্রিকান-আ্যমেরিকান গানের সঙ্গে লোরকা এক গভীর সাদৃশ্য খুঁজে পান স্প্যানিশ গানের। নিউ ইয়র্কে থাকার সময় লেখা কিছু কবিতা থেকেই বাংলায় অনুদিত করা হল এখানে প্রকাশিত কবিতাগুচ্ছ।

 স্পেইনে বেড়ে চলা ফ্যাসিসম এর মধ্যেও লোরকা কখনওই লুকিয়ে রাখেননি তাঁর বামপন্থী ধ্যানধারণা এবং সমকামীতা। ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে, স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের শুরুতে ফ্রান্সিস্কো ফ্র‍্যানকোর সেনা বাহিনী গ্রানাডা থেকে আ্যরেস্ট করে এবং গুলি করে মেরে করা হয় লোরকাকে। 

ধ্বংস
রেজিনা সাইনস দে লা মাজা-কে

নিজেকে না খুঁজে পেয়ে
শুভ্র শরীর ঘুরে
বাতাস তার পথ করে নেয়!
অচিরেই বোঝা গেল চাঁদ
নাকি ঘোড়ার করোটি,
বাতাস, এক আঁধার আপেল

আলো আর কশাঘাতে
জানলার ওপারে, বুঝি,
বালি আর জলের বিবাদ

দেখেছি দলবদ্ধ ঘাসের আগমন
ছোট ছোট দাঁত আর শল্যছুরির দিকে
ছুঁড়ে দি আর্ত কচি পাঁঠা

পালক আর পালস্টিক আবৃত
প্রথম কবুতর
ওড়ে বিন্দুটির ভিতর

ঘুমন্ত মেঘমালা
পাথর আর ভোরের দ্বন্দে
চোখ রাখে

শূন্য আকাশ জুড়ে, দেখো বাছা,
ঘাসের তরবারি
ওই, রিনরিন বাজে
হাত রাখো হাতে, প্রিয় ঘাস
ভাঙা জানলার ফাঁকে
খোলা থাক বানভাসী রক্তের চুল

তুমি আর আমি শুধু
বাতাসের উদ্দেশ্যে কঙ্কাল সাজাও
অবশিষ্ট আমি আর তুমি

সাজাও কঙ্কাল, প্রস্তুত হও, প্রিয়,
আমাদের ঘুমহীন অবয়ব খুঁজে বের করো


মৃত্যু
ইসিদোরো দে ব্লাস-কে

কী অক্লান্ত প্রচেষ্টা ওদের!
ঘোড়াটি প্রাণপণে কুকুর হ'তে চায়!
কুকুরটির উপক্রম পাখি হয়ে ওঠার
পাখি? সে তো ভেবেছিল ভ্রমর হবে
ভ্রমরের মনে মনে ঘোড়া হওয়ার সাধ
আর ঘোড়া?
কী তীক্ষ্ণ তীর টানে গোলাপের থেকে,
কী ফ্যাকাশে গোলাপ ওঠে তার ঠোঁটে ভেসে!
গোলাপ,
সে এক ঝাঁক আলো আর চিৎকার
শরীরী শর্করায় রাখে গ্রন্থিত!
আর শর্করা!
কী ছুরিকা আসে তার সতর্ক স্বপনে!
ছুরিরা সকলে, তাই
আস্তাবলহীন কোনও চাঁদ, কোনও নগ্নতা
চির দগদগে মাংসপেশী খোঁজে!
এবং আমি, এই ছাদের কিনারে
দাউদাউ পরী খুঁজি, আমিই!
ওই পাথুরে মিনার তবু
কী প্রকান্ড, কী অদৃশ্য, কী ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা নির্বিশেষে


বেড়িয়ে এসে

খন্ডিত করেছে আকাশ
স্ফটিকলোভী আকৃতি
পাপের প্রতি ধাবমান আকৃতির মাঝে
পেয়েছি চুল বাড়ানোর অবকাশ

বিকলাঙ্গ গাছ, যে গাইবে না গান
শূন্য ডিম্বাণুর মতন যে শিশু
তারা ছিল সাথী
ক্ষুদ্র প্রাণির চৌচির খুলি
জীর্ণ-বেশ জল, কেবল শুকনো দুই পা
ছিল তারাও
শ্রান্ত, মূক-বধির যা কিছু
দোয়াতে ডুবন্ত প্রজাপতি
সঙ্গে নিলাম

নিজের সঙ্গে দেখা, বিচিত্র, দৈনন্দিন
খন্ডিত করেছে আকাশ!


ভোর

নিউ ইয়র্কের ভোর-
পঙ্কিল চার-মিনার
কালো পায়রার ঝড়
আছড়ে পড়ছে দূষিত উপকূলে

নিউ ইয়র্কের ভোর-
আগুনের প্রকান্ড প্রস্থানপথে
আনাচেকানাচে গোঙানো অন্বেষণ
নিদারুণ যন্ত্রণার অতিবাহিত সুগন্ধী রেশ

আগমনী ভোর কেউ মুখে তুলে নেয়না
যেখানে সকাল অসম্ভব প্রত্যাশাও
মাঝেমধ্যে ছুটে আসে ক্ষুদ্র খুচরো কয়েন
পেরেকের ধারে বিদ্ধ করে অনাথ শিশুদের গোগ্রাসে খাবে বলে

যারা উঠে পড়েছে খুব ভোরে, তারা জানে
মৃত, কুসুমিত কোনও স্বর্গ বা প্রেম নেই
দলিত সংখ্যায়,  আইনেই সকলের পরিণতি
নির্বোধ খেলা, নিষ্ফল শ্রমে

শিকল আর শব্দের ভারে চাপা আলো
অমূলক বিজ্ঞানের নির্লজ্জ বিপরীত
সাধারণ মানুষের ঘুমহীন ঘোরাফেরা সেখানে
এইমাত্র, ঠিক যেন, পালিয়েছে রক্তের নৌকাডুবী


নিউ ইয়র্ক: অন্ধ প্যানোরামা

ছাই-মাখা পাখি না হয় যদি
পরিণয় বাতায়নে ধ্বনিত কান্না না হয়
বাতাসের সূক্ষ্মাতি জীব, তবে,
ঝরিয়েছে তাজা রক্ত অনির্বাপিত অন্ধকারে

পাখি নয়,
তারা নিমেষেই নেবে বৃষ-পরিচয়
চাঁদের সাহায্য পেলে শ্বেতপাথর সম্ভাবী
তারা, বরাবর ক্ষতবিক্ষত আহত ললনা
বিচারসভা যতক্ষণ আবরণ রাখে

মৃত্যুশোক বোঝে সকলেই
ব্যথা তবু বাঁচেনা আত্মায়
বাতাসে নয়, জীবনে নয়
ঘুরপাক ধোঁয়াদের সোপানেও নয়
প্রকৃত বেদনা যা জাগ্রত রাখে চরাচর
ক্ষুদ্র সে,
দ্বিতীয় তন্ত্রের নিষ্পাপ দু'চোখের অসীম দাহন
আকাশ মুহুর্মুহ ঝেড়ে ফেলে ভারী হয়ে কাঁধে চাপা পরিত্যক্ত পোষাক
জীর্ণ অবিচ্ছিন্নতায়
মৃত যারা, প্রসবের কালে, প্রহরে শেষে তারা জানে
প্রতিটি অস্ফুট স্বর পাথর, আর, পদক্ষেপ আসলে স্পন্দন

ভুলে থাকি, মনের গভীরে কত ভাগাভাগি চলে
চৈনিক যা কিছু, সাথে শুঁয়োপোকা, গিলে খায় দার্শনিক
পঙ্গু পাখির বাস রান্নাঘরে, তারা জানে প্রেমের উচ্চারণ
এ সকল অবুঝ শিশুর আবিষ্কার

পাখি নয়,
ঘূর্ণির অসহ্য জ্বর আর অবদমনকারী হত্যার ইচ্ছাটুকু
পাখিরা প্রকাশে ব্যর্থ
কিংবা আত্মহননের ধাতব গুনগুন
তার কাছে প্রতিটি সকালের ঋণ

এক কোষ বাতাস, তা'তে এক পৃথিবী দুর্ভোগ
ক্ষুদ্রকায় পরিসরে বেঁচে থাকা আলোর উন্মাদ মিলন
ভুলে থাকে
অবর্ণনীয় সিঁড়ির শিখরবাসী মেঘ ও গোলাপ
ফুটন্ত চৈনিক হাহাকার রক্তের বন্দরে

আমি প্রায়শ হারিয়েছি আমায়
সমগ্র জাগিয়ে রাখা দহন সন্ধানে
রেলিঙের গায়ে ঝুঁকে পড়া নাবিক
আর বরফে প্রোথিত কিছু আকাশের জীব
শুধু পেয়েছি উত্তর

প্রকৃত বেদনা তবু ছিল সেইখানে
বৃক্ষের কান্ডস্থ মৃত্যুগামী স্ফটিক মাছ যেখানে;
প্রাচীন মুর্তিদের আচেনা নীল আকাশের দেশে,
আগ্নেয়গিরির ঘনিষ্ঠ পেলবতায়

কন্ঠস্বরে নেই বেদনা কোথাও
কালো মখমলে বাকরুদ্ধ বিক্ষিপ্ত দাঁত আছে কিছু
কন্ঠস্বরে কোনও ব্যথা নেই কেবল পৃথিবী এখানে
আর আছে
ফলের রক্তিম আভাগামী নিরন্তর কপাট



1 comment:

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে