অমরকান্ত
বলা হয় হিন্দি কথা সাহিত্যে মুন্সী প্রেমচন্দের
পরেই অমরকান্তের নাম উঠে আসে। তাঁর গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে স্বাধীনতা পরবর্তী
ভারতের আর্থিক এবং সামাজিক শোষণের দিকটি খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্যিক
অমরকান্তের জন্ম উনিশশো পঁচিশ সালে উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলায়। তাঁর লিখিত
সাহিত্যকৃতিগুলি হল,
উপন্যাস : সুখা পত্তা,
আকাশ পক্ষী, সুখজীবী,বীচ কা দিওয়ার, সুন্নর পান্ডে কী
পতোহু, ইনহি
হথিয়ারো সে ইত্যাদি। গল্প
সমগ্র : জিন্দেগী ঔর জোঁক, মৌত কা নগর,তুফান, এক ধনীব্যক্তি কা বয়ান, দুখ ঔর দুখ কা সাথ ইত্যাদি । পুরষ্কার পেয়েছেন সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু পুরষ্কার, মৈথিলীশরণ
গুপ্ত শিখর পুরষ্কার, সাহিত্য অকাদেনি সম্মান,
জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার, মহাত্মা গান্ধী পুরষ্কার ইত্যাদি। ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এলাহাবাদে তিনি শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দ্বিপ্রাহরিক ভোজন
'বড়কু, বড়কু ! রামচন্দ্রের কোনো
সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে ওর নাকের নিচে হাত রেখে দেখতে লাগল। শ্বাস ঠিক মতোই
চলছে। কপালে হাত রেখে দেখল জ্বরও ছিল না। হাতের স্পর্শ পেয়ে রামচন্দ্র চোখ খুলল।
প্রথমে ও অত্যন্ত ক্লান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো তারপরেই ঝট করে উঠে বসল।
চপ্পল খুলে,চৌকির নিচে রাখা জল দিয়ে হাত-পা ধোয়ার পর যন্ত্রচালিতের মতো চৌপায়ায়
এসে বসল।
সিদ্ধেশ্বরী ভয়ে ভয়ে
জিজ্ঞাসা করল,
"রান্না হয়ে গেছে।
এখানেই দেব কি? "
রামচন্দ্র উঠতে উঠতে
জানতে চাইল,
বাবা খেয়েছে কিনা? সিদ্ধেশ্বরী
রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে বলল,
"এখুনি
আসবে।"
রামচন্দ্র পিঁড়িতে এসে
বসল। ওর বয়স প্রায় একুশ বছর হবে। লম্বা, রোগাপাতলা চেহারা, ফরসা রঙ,বড় বড় চোখ আর
ফাটা ঠোঁট। ও স্হানীয় একটি সাময়িক পত্রের অফিসে প্রুফ রিডিংএর কাজ শিখছে। গত বছরই
ও ইন্টার পাশ করেছে। সিদ্ধেশ্বরী খাওয়ার থালা এনে রামচন্দ্রের সামনে রেখে পাশে বসে
হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগল। রামচন্দ্র থালার দিকে নিস্পৃহ দার্শনিকের মতো
তাকালো একবার। তাতে ছিল দুটি রুটি, এক বাটি পতিয়াই ডাল আর ছোলার তরকারি। রামচন্দ্র রুটির প্রথম
টুকরোটা মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞেস করল,
"মোহন কোথায়? বাইরে আজ প্রচন্ড
রোদ।"
মোহন সিদ্ধেশ্বরীর
মেজোছেলে। আঠারো বছরের মোহন এ বছর হাইস্কুলের প্রাইভেট পরীক্ষা দেওয়ার উদযোগ
নিচ্ছে। মোহন অনেকক্ষণ থেকেই বাড়িতে ছিল না আর সত্যি বলতে
কী সিদ্ধেশ্বরীর কাছে কোনো উত্তরও ছিল না মোহন কোথায় যেতে পারে সে সম্পর্কে।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে ওর ইচ্ছে করল না তাই বললো,
" কোনো বন্ধুর
বাড়ি পড়তে গেছে, এখুনি এসে পড়বে। ভারি বুদ্ধিমান বন্ধুটি। সারাক্ষণ শুধু পড়া আর
পড়া। মোহন সবসময়ই এই বন্ধুর কথা বলে। "
রামচন্দ্র কিছু না বলে
এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে আবার রুটি চিবোতে লাগল। রুটির ছোটছোট
টুকরো করে খুবই আস্তে আস্তে খেতে লাগল। সিদ্ধেশ্বরী ভয়ে ভয়ে ছেলেকে দেখতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করল,
" ওখানে কিছু হল?
"
রামচন্দ্র তার বড় বড়
ভাবলেশহীন চোখে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার খাবারে মন দিল। কিছুক্ষণ পর রুক্ষ
স্বরে জবাব দিল,
"সময় এলে সবকিছু
ঠিক হয়ে যাবে। "
সিদ্ধেশ্বরী চুপ করে
বসে রইল। রোদ আরো প্রখর হয়ে উঠছিল। আকাশে এক দু টুকরো মেঘ নৌকোর মতো ভেসে যাচ্ছিল,
উঠোনে তার ছায়া পড়ছিল। বাইরে গলি দিয়ে চলে যাওয়া একটা এক্কাগাড়ির খড়খড়ে আওয়াজ
বাড়ির ভিতর অব্দি আসছিল। তার সাথে মিশে যাচ্ছিল চারপাইয়ের ওপর ঘুমন্ত ছেলের
শ্বাসের ঘরঘর শব্দ।
রামচন্দ্র হঠাৎই
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল,
" প্রমোদ খেয়েছে?
"
সিদ্ধেশ্বরী প্রমোদের
দিকে তাকিয়ে উদাস স্বরে জবাব দিল,
" হ্যাঁ, খেয়েছে।
"
" কাঁদেনি তো?
"
সিদ্ধেশ্বরী আবার সত্য
গোপন করে বলে উঠল,
" আজ একেবারেই
কান্নাকাটি করেনি। ও খুবই হুশিয়ার হয়ে উঠেছে। বলছিল, বড়দাদার কাছে যাব। এমনই
ছেলে... "
এর পর সিদ্ধেশ্বরীর আর
কথা যোগালো না। মনে হল যেন ওর গলায় কিছু আটকে গেছে। মনে পড়ল গতকাল প্রমোদ রাবড়ি
খাবার জন্য অত্যন্ত জেদ করেছে। প্রায় আধঘন্টা জেদ করার পর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে
পড়েছে।
রামচন্দ্র কিছুটা
আশ্চর্য হয়ে মাকে দেখল তারপর আবার মাথা নিচু করে খেতে শুরু করল। রুটির শেষ
অবশেষটুকু দেখে সিদ্ধেশ্বরী ওঠার উপক্রম করতে করতে বলল,
" আরো একটা রুটি
দিই? "
রামচন্দ্র তাড়াতাড়ি হাত
নাড়িয়ে বারণ করল।
" না না, আর একটাও নয়। আমার পেট
অনেক আগেই ভরে গেছে। আমি তো এটুকুও আর খেতে পারছি না। ব্যাসস, আর না। "
সিদ্ধেশ্বরী জেদ করতে
লাগল,
" আর আধখানা
"
রামচন্দ্র রেগে গেল।
" বেশি খাইয়ে শরীর
খারাপ করার ইচ্ছে নাকি তোমার? তোমরা বিন্দুমাত্র ভাবো না। সবসময় নিজের জেদ।
খিদে থাকলে চেয়ে নিতাম না নাকি? "
সিদ্ধেশ্বরী চুপচাপ
যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে রইল।
রামচন্দ্র রুটির শেষ
টুকরোটা থেকে হাত সরিয়ে নিল। লোটা এগিয়ে মাকে জল এনে দেওয়ার কথা বলল।
সিদ্ধেশ্বরী জল আনতে
উঠে গেল।
রামচন্দ্র বাটির উপর
আঙুল দিয়ে বাজনার বোল তুলতে লাগল তারপর থালার উপর নামিয়ে নিল হাত। কিছুক্ষণ পর
রুটির শেষটুকরোটি ধীরেধীরে তুলে এদিকওদিক তাকিয়ে মুখের মধ্যে এমন ভাবে পুরে দিল
যেন ওটা কোনো রুটির টুকরো নয় সুস্বাদ পানের খিলি।
মেজো ছেলে মোহন এসেই হাত-পা ধুয়ে পিড়িতে বসে
পড়ল। মোহনের গায়ের রঙ শ্যামলা আর চোখদুটো ছোটছোট। কোনো এক সময়ে হওয়া বসন্ত দাগ রেখে গেছে ওর
মুখে। ও ভাই রামচন্দ্রের মতোই রোগাপাতলা কিন্তু অতটা লম্বা নয়। ওকে দেখাচ্ছিল
বয়সের চেয়েও বেশি গম্ভীর ও উদাস।
সিদ্ধেশ্বরী খাবারের
থালা ছেলের সামনে রাখতে রাখতে প্রশ্ন করল,' কোথায় ছিলি এতক্ষণ? দাদা তোর কথা জিজ্ঞেস
করছিল।'
মোহন রুটির একটা বড়
গ্রাস গিলে ফেলার চেষ্টা করতে করতে মোটা গলায় বলল, ' কোথাও তো যাইনি।এখানেই
ছিলাম।'
সিদ্ধেশ্বরী পাখা
দুলিয়ে ছেলেকে হাওয়া করতে করতে স্বগতোক্তির ঢঙে বলে উঠল,' দাদা তোর বড় তারিফ
করছিল। বলছিল, মোহন খুবই বুদ্ধিমান। সবসময় পড়ার দিকেই ওর ঝোঁক। ' এ কথা বলে
সিদ্ধেশ্বরী ছেলের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে কোনো চুরির অপরাধে ধরা পড়েছে ।
মোহন মায়ের দিকে তাকিয়ে
ফ্যাকাসে হাসি হেসে আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দিল। থালায় পরিবেশিত দুটি রুটির
মধ্যে একটা রুটি দিয়েই ও তিন-চতুর্থাংশ ডাল আর অধিকাংশ তরকারিই শেষ করে ফেলেছিল।
সিদ্ধেশ্বরী বুঝতে
পারছিল না ওর কী করনীয়। এই দুটি ছেলেকে ও খুব ভয় পেত। হঠাৎ ওর চোখে জল
এল। ও মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে।
কিছুক্ষণ পর ছেলের দিকে
তাকাল ততক্ষণে মোহনের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
সিদ্ধেশ্বরী জিজ্ঞেস
করল,' আরেকটা রুটি দিই?'
মোহন রান্নাঘরের দিকে
কেমন যেন রহস্যময় দৃষ্টিতে দেখল, তারপর বলল,'না'।
সিদ্ধেশ্বরী তবু অনুনয়
করে বলতে লাগল,
'আমার দিব্যি তোকে, আরো
একটা রুটি নিতেই হবে। দাদাও তো একটা রুটি নিয়েছিল। '
মোহন মন দিয়ে মাকে
দেখল, তারপর শিক্ষক যেমন ছাত্রকে বোঝায় তেমন ভাবেই বলল,' না
গো, অনেক হয়েছে। এখন আর খিদে নেই। তার উপর তুমি রুটি এমন বানিয়েছ যে খাওয়াই
মুশকিল। বলতে পারছি না যে কেমন লাগছে। যাকগে, যদি তুমি চাও তাহলে আরো একটু ডাল
দাও। ডাল খুব সুন্দর হয়েছে।'
সিদ্ধেশ্বরী চুপচাপ
খানিকটা ডাল ছেলের বাটিতে ঢেলে দিল। মোহন বাটি মুখের কাছে নিয়ে সুরসুর করে খেতে
লাগল। এমন সময় মুন্সী চন্দ্রিকা প্রসাদ জুতোর খসখস আওয়াজ করতে করতে ঘরে ঢুকে রামের
নাম নিতে নিতে চৌকিতে বসে পড়লেন। সিদ্ধেশ্বরী ঘোমটা আরো একটু নিচে টেনে নিল। মোহন
এক নিঃশ্বাসে চটপট ডালটুকু শেষ করে, জলের লোটা হাতে নিয়ে দ্রুতই ঘর থেকে বেরিয়ে
গেল।
দুটো রুটি,একবাটি ডাল
আর ছোলার তরকারি। মুন্সী চন্দ্রিকা প্রসাদ পিড়িতে থেবরে বসে এমন আয়েস করে চিবোতে
লাগলেন যে দেখে মনে হল বুড়ি গোরুটা জাবড় কাটছে। ওনার বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর কিন্তু
দেখে মনে হয় যেন পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। চামড়া ঝুলে পড়েছে। চুলবিহীন মাথা আয়নার মতো চকচক
করছে। নোংরা ধুতির উপর অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার গেঞ্জি যেন ঝুলছিল শরীর থেকে।
মুন্সীজি বাটি থেকে ডাল
চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,' বড়কা কে দেখছি না যে? '
সিদ্ধেশ্বরী কিছুতেই
বুঝতে পারছিল না আজ ওর হলটা কী? মনে হচ্ছে যেন হৃদয়টাতে কেউ ছুরি চালাচ্ছে। পাখা
আরো জোরে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,' এইমাত্র খেয়েদেয়ে কাজে গেল। বলছিল আর কিছুদিনের
মধ্যেই চাকরি পেয়ে যাবে। সবসময়, বাবুজি, বাবুজি, করতে থাকে। বলে, বাবুজি দেবতার
সমান। '
মুন্সীজীর মুখে যেন
কিছুটা আলো খেলে গেল। লজ্জা পেয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসতে হাসতে বললেন, 'কী যে বলে ও।
পাগল ছেলে একটা।'
সিদ্ধেশ্বরীকে যেন আজ
নেশায় ভর করেছে। উন্মাদগ্রস্ত রোগীনির মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগল,' পাগল নয় গো, বড়ই
বুদ্ধিমান। আগের যুগের কোনো মহাত্মা হবে। মোহন তো ওকে ভীষণ সম্মান করে। আজই তো
বলছিল, শহরে দাদার অনেক কদর। লেখাপড়া জানা লোকেরাও ওকে ডেকে আদর করে। আর বড়কা তো
ছোট ভাইদের জন্য মরে যেতেও রাজি। দুনিয়ার অনেক কিছু ও সহ্য করে নেবে কিন্তু
কিছুতেই প্রমোদের কিছু হলে ও সেটা সহ্য করতে পারবে না। '
মুন্সীজী হাতে লেগে
থাকা ডাল চাটছিলেন। সামান্য হেসে সামনের তাকের দিকে তাকিয়ে উনি বললেন,' বড়কার মাথা
সত্যিই খুব তাড়াতাড়ি চলে।ছোটবেলায় ও খুবই চঞ্চল ছিল। সবসময় শুধু খেলত। কিন্তু এটাও
ঠিক যে যে পড়াটাই আমি ওকে করতে দিতাম সেটাই ঠিক ঠিক মনে রাখতে পারত। আসলে তিনজনই
খুব বুদ্ধিমান। প্রমোদকে তুমি কম ভেবেছ বুঝি? ' এ কথা বলে
মুন্সীজী হঠাৎই জোরে জোরে হেসে উঠলেন।
দেড়খানা রুটি খেয়ে
নেওয়ার পর তিনি একটি গ্রাস নিয়ে যেন যুদ্ধ করছিলেন। একগ্লাস জল খেয়ে সামলে নিলেন।
তারপর কাশতে কাশতে আবার খাওয়ার দিকে মন দিলেন।
ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা
ছেয়ে গেল। দূর থেকে কোনো আটাচাকীর পুক-পুক আওয়াজ ভেসে আসছিল আর কাছের উঠোনের নিমগাছটাতে বসে
একটা পাখি লাগাতার ডেকে যাচ্ছিল। সিদ্ধেশ্বরী বুঝতে পারছিল না কী বলবে। সবকিছু
ঠিকঠাক জেনে নিতে চাইছিল ও। সমস্ত বিষয় ঠিকঠাক জেনে নিয়ে আগের মতোই জোরদার কথা
বলার ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছিল না। ওর মনের মধ্যে না জানি কিসের
একটা আতংক বাসা বেধেছিল। এদিকে মুন্সীজী এতটাই চুপচাপ খাচ্ছিলেন যে মনে হল উনি
কয়েকদিন ধরে মৌনব্রত ধারণ করেছেন এবং আজই সন্ধ্যায় কোথাও গিয়ে তা তিনি ভাঙবেন।
মৌনতা ভেঙে সিদ্ধেশ্বরী
বলে উঠল,' মনে হচ্ছে এবার বৃষ্টি হবে না।'
মুন্সীজী এদিকওদিক দেখে
নির্বিকার স্বরে রায় দিলেন,' মাছি বেড়ে গেছে অনেক। '
সিদ্ধেশ্বরী উৎসাহিত
হয়ে জিজ্ঞেস করল,' ফুফা জী অসুস্থ। অনেকদিন হল তাঁর কোনো খবর আসেনি। '
মুন্সী জী ছোলার তরকারি
চিবোতে চিবোতে এমনভাবে তাকালেন যেন এ বিষয়ে তিনি আলোচনা করতে চান কিছু। তারপর
বললেন,' গঙ্গাশরণবাবুর মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্র এম.এ পাশ। '
সিদ্ধেশ্বরী হঠাৎ চুপ
হয়ে গেল। মুন্সীজীও আর কিছু বললেন না। ওঁর খাওয়া শেষ হয়ে গেছিল। বাচাকুচা
টুকরোগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন দুষ্টু বাঁদরের মতো।
সিদ্ধেশ্বরী বলল,'
বড়কার দিব্যি, আরো একটা রুটি নাও। এখনও অনেক আছে। '
মুন্সী জী বউয়ের দিকে
একবার আর রান্নাঘরের দিকে একবার দেখে ওস্তাদের মতো বললেন, ' রুটি? থাক। পেট অনেক ভরে
গেছে। ভাত আর নোনতা খাবার খেতে আমার আর ইচ্ছে করছে
না। তুমি শুধু শুধুই কসম দিলে। ঠিক আছে কসম রাখার জন্যই শুধু নিচ্ছি। গুড় আছে নাকি? '
সিদ্ধেশ্বরী জানাল
হাঁড়িতে কিছুটা গুড় আছে।
মুন্সী জী উৎসাহিত হয়ে
বলল,' তাহলে গুড়ের ঠান্ডা রস বানাও, খাই। তোমার কসমও রাখা হবে, স্বাদও কিছুটা
বদলানো যাবে। তার সাথে সাথে হজমও হয় যাবে। সত্যি, রুটি চিবোতে চিবোতে প্রাণটা গেল।
' বলতে বলতে মুন্সী জী জোরে জোরে হেসে উঠলেন।
মুন্সী জীর খাওয়া হয়ে
যাওয়ার পর সিদ্ধেশ্বরী তাঁর এঁটো থালা নিয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পড়ল। বড় পাত্র
থেকে ডাল বাটিতে ঢেলে দিল কিন্তু তা পুরোটা ভরল না। ছোলার তরকারিও আর সামান্যই
বেঁচেছিল, ওটাকেও টেনে নিল। রুটির থালাটাও টেনে নিল নিজের দিকে। মাত্র একটাই রুটি
ছিল তাতে। মোটা বিচ্ছিরি আর পোড়া রুটিটা নিয়ে এঁটো থালাটায় সিদ্ধেশ্বরী খেতে শুরু
করতে যাচ্ছিল আর তখনই চোখ পড়ল ঘুমন্ত প্রমোদের দিকে। ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে
থেকে রুটিকে মাঝখান থেকে দু'টুকরো করে ফেলল সিদ্ধেশ্বরী। একটা টুকরো তুলে রেখে
অন্য টুকরোটা নিজের থালায় নিল। তারপর এক লোটা জল নিয়ে খেতে বসে গেল। প্রথম গ্রাসটা
মুখে যেতেই সিদ্ধেশ্বরীর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল টপটপ করে।
পুরো ঘর মাছিতে ভিনভিন
করছিল। উঠোনে একটা নোংরা শাড়ি ঝুলছিল। দুই ছেলের কারোরই কোনো হদিস ছিল না। বাইরের
ঘরে মুন্সী জী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছিলেন এমনভাবে যেন দেড়মাস আগে মকান-কিরায়া
বিভাগের ক্লার্কের চাকরিটা তার চলে যায়নি আর সন্ধেবেলা তাঁকে কোনো নতুন কাজের
খোঁজে কোথাও যেতে হবে না।
No comments:
Post a Comment