Friday, October 12, 2018

চেতন, অচেতন ও দুটি স্বপ্নঃ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং ভাষান্তরঃ অনিমিখ পাত্র






চেতন, অচেতন ও দুটি স্বপ্নঃ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং
ভাষান্তরঃ অনিমিখ পাত্র

(  কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং যে শুধুমাত্র দিক্‌পাল মনস্তত্ববিদ, মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ফ্রয়েডের সঙ্গে সমোচ্চারিত নাম, ‘কালেকটিভ আনকনশাস’ এর প্রবক্তা তাই নয়, আমার মতে তিনি একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়কও বটে। আমি ইয়ুং কে অভিহিত করতে চাই এক মহান ‘চিন্তাশিল্পী’ হিসেবে। গবেষণার পাশাপাশি লিখেছেনও প্রচুর, যার অনেকটা অংশ এমনকি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। রাজনীতি থেকে আধ্যাত্মিকতা – সর্বত্র তাঁর অবাধ বিচরণ। ‘অবজার্ভার’ পত্রিকা তাঁর লেখার সম্পর্কে লিখছে যে – ‘তা কখনো কখনো একজন ব্লেক কিংবা একজন নীৎশে কিংবা একজন কিয়ের্কেগার্দ এর উচ্চতায় পৌঁছে যায়। যেকোনো প্রকৃত প্রফেট কিংবা শিল্পীর মতোই তিনি মানুষের কল্পনার বিস্তারটাকে বাড়িয়ে তুলেছেন। ইয়ুং এর ভাবনাকে ধরতে পারা হল কোনো মুক্ত মনের এক আবশ্যিক সক্ষমতার পরিচায়ক।‘
ঠিক এই সৃজনশীলতা এবং কল্পনার দুর্ধর্ষ উড়াল এর কারণেই ইয়ুং এর কোনো কোনো বাক্যকে কবিতার লাইন মনে হয়। কোন কোনো চিন্তাকে মনে হয় যেন সাই-ফাই ছবি থেকে আহৃত। কখনো কখনো খানিকটা আজগুবিও। কবি-লেখক-শিল্পী-বিজ্ঞানী আদতে হলেন সন্ধানীজন। কল্পনা সবক্ষেত্রেরই মূল জ্বালানী। আমি যখন এই বইটি পড়ি, যা থেকে এই অনুবাদপ্রয়াসটি করেছি, এই কল্পনার অভূতপূর্ব রত্নঝিলিকেই আমার দিনরাত বদলে গিয়েছিল। এক একটা লাইন পড়ি আর থামি। স্বীকার করি, মনস্তত্বের টেকনিকাল জ্ঞান আমার নেই। ফলত, টার্মগুলি মূলানুগ নাও হতে পারে, আমি আমার বোধ অনুসারে অনুবাদের চেষ্টা করেছি। লেখাটিও ইয়ুং এর আত্মজীবনীর একটি অধ্যায় ‘On Life After Death’ থেকে নেওয়া এক খন্ডাংশ। শিরোনামটি আমার দেওয়া। )


আমাদের কোনোকিছুই শাশ্বত’র জন্য সংরক্ষিত থাকে কিনা সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট দৃঢ় প্রমাণের অভাব আছে। বড়জোর আমরা বলতে পারি, মনের (psyche) কোনো একটা অংশ শারীরিক মৃত্যুকে ছাপিয়ে গিয়ে ক্রিয়া করে – এরকম একটা সম্ভাবনা আছে। আমরা এটাও জানি না যে অংশটা রয়ে যাচ্ছে সেটা তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিনা। এ বিষয়ে মতামত গড়ে তুলতে গেলে আমাদের মানসিক পৃথকীকরণ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। ভেদমূলক গূঢ়ৈষা (split-off complex) যেসব কেস্‌-এ দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমনভাবে প্রকাশিত হয় যেন মনে হয় সেই গূঢ়ৈষাটি নিজেই নিজের সম্পর্কে সচেতন। তাই, পাগলেরা যে সব কন্ঠস্বর শুনতে পায় সবই কোনো না কোনো ব্যক্তির। ইচ্ছা করলে এইসমস্ত গূঢ়ৈষাকে আমরা সচেতনতার প্রবাহেরই একটা প্রমাণ হিসেবে ধরতে পারি। একইভাবে, এই ধারণার সপক্ষে কিছু বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ উঠে আসে কিছু কেস্‌-এ যখন মস্তিষ্কে তীব্র আঘাতের ফলে মানুষ সাময়িক সংজ্ঞা হারায় কিংবা চূড়ান্তভাবে কোনো ভেঙে পড়ার অবস্থায় চলে যায়।

দুই ক্ষেত্রেই, সম্পূর্ণ চেতনা হারিয়ে ফেলার সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে বাহির পৃথিবীর উপলব্ধি এবং প্রগাঢ় স্বপ্ন-অভিজ্ঞতা। যেহেতু সেরিব্রাল কর্টেক্স, যেখানে চেতনা থাকে, এইসময় কাজ করে না, এইরকম উপলব্ধি-অভিজ্ঞতার তাই কোনো ব্যাখ্যাও হয়না। এগুলি, অন্ততপক্ষে, চেতনার একটি স্বনির্ভরভাবে টিকে থাকতে পারার প্রমাণ হতে পারে – এমনকি বাহ্যিকভাবে অচেতন অবস্থার মধ্যেও।

আমার দুটি স্বপ্নের মধ্যে এই – শ্বাশ্বত মানব, আত্মন্‌ (self), এবং টাইম-স্পেস এর ভেতরে পার্থিব মানব – এই সম্পর্কের কন্টকময় সমস্যাটি ফুটে উঠেছে।
একটা স্বপ্নে, যেটা ১৯৫৮-র অক্টোবরে দেখেছিলাম, আমার বাড়ি থেকে দুটো উজ্জ্বল ধাতব লেন্স-আকৃতির চাকতি দেখতে পেয়েছিলাম আমি, সেগুলো বাড়ির ওপর দিয়ে সরু উপবৃত্তাকার পথে সশব্দে উড়ে গিয়ে হ্রদে নেমে গেছিল। সেগুলো ছিল দুটো ইউ.এফ.ও. (Unidentified Flying Object)। তারপর আরেকটা জিনিষ সরাসরি আমার দিকে উড়ে এল। সেটা একদম নিখুঁত গোলাকৃতি লেন্স, টেলিস্কোপের মতো। চার-পাঁচশ গজ দূরত্বে এসে সেটা থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত, তারপর উড়ে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সাঁই সাঁই করে বাতাস কেটে উড়ে এল আরেকখানা – একটা লেন্স, তার সঙ্গে যুক্ত একটা ধাতব জিনিষ যেটা ক্রমে একটা বাক্সে পরিণত হয়েছে – অর্থাৎ একটা ম্যাজিক লন্ঠন। ষাট-সত্তর গজ দূরত্বে এসে সেটা বাতাসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, একদম আমার দিকে তাক করে। একটা বিস্ময়ের অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠলাম আমি। তখনও স্বপ্নের অর্ধেকটায়, একটা চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেলঃ “আমরা সবসময়ই ভাবি যে ইউ.এফ.ও. হল আমাদেরই তৈরি ভাবনারূপ (projection)। এখন দাঁড়াচ্ছে যে আমরাই আসলে ওদের ভাবনারূপ। ম্যাজিক লন্ঠনের দ্বারা আমি সি.জি.ইয়ুং বলে রূপায়িত হচ্ছি। কিন্তু এই যন্ত্রটা চালাচ্ছে কে?”

          এই আত্মন্‌ আর অহং (ego) এর সমস্যা নিয়ে আমি আগেও একবার স্বপ্ন দেখেছি। এই আগের স্বপ্নে আমি পাহাড়ে হাঁটতে গেছি। একটা পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপের ভেতর দিয়ে একটা ছোট্ট রাস্তায় আমি হাঁটছিলাম। সূর্য ঝকঝক করছিল আর আমি চারদিক খোলা একটা বিস্তৃত দৃশ্যপট দেখতে পাচ্ছিলাম। তারপর রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট প্রার্থনাঘর বা চ্যাপেল-এ এলাম আমি। দরজাটা ছিল হাট করে খোলা, আমি ঢুকে পড়লাম। অবাক হয়ে দেখলাম, বেদিতে কোনো ভার্জিন মেরি’র মূর্তি নেই, কোনো ক্রুশবিদ্ধ যিশুও না, কেবলমাত্র দুর্দান্ত এক ফুলের নক্‌শা সাজানো। কিন্তু তারপর আমি দেখলাম যে, বেদির সামনে মেঝের ওপর, আমার দিকে মুখ করে, বসে আছেন এক যোগী – পদ্মাসনে, গভীর ধ্যানমগ্ন। যখন আমি তাকে আরও ভালো করে দেখলাম, আমি বুঝতে পারলাম যে যোগীর মুখটা আসলে আমারই মুখ। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম আমি আর জেগে উঠলাম এই চিন্তাটাকে সঙ্গে করেঃ “আচ্ছা, তাহলে এই সেই লোক যিনি আমাকে ধ্যান করছেন। উনি একটা স্বপ্ন দেখছেন এবং আমিই হলাম সেই স্বপ্ন।“ আমি বুঝেছিলাম যে যখন তিনি জাগবেন, আমি আর থাকবো না কোথাও।
এই স্বপ্নটা আমি দেখেছিলাম ১৯৪৪ এ আমার অসুস্থতার পর। এটা আসলে একটা নীতিকাহিনী। আমার আত্মন্‌ ধ্যানের মধ্যে ঢুকে যায় এবং আমার পার্থিব অস্তিত্বকে ধ্যান করতে থাকে। আরেকভাবে দেখতে গেলেঃ ত্রিমাত্রিক অস্তিত্বের মধ্যে আসার জন্যই মানবরূপ ধরে সে, যেন সমুদ্রে ঝাঁপ দেবে বলে ডুবুরির পোশাক পরে নিচ্ছে কেউ। যখন পরবর্তীকালে সে অস্তিত্ব ত্যাগ করে, আত্মন্‌টি একটি ধর্মীয় আসন পরিগ্রহ করে, স্বপ্নে ওই চ্যাপেলটি যেমন দেখিয়েছিল। পার্থিব চেহারায় সে ত্রিমাত্রিক জগতের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে পারে, এবং আরও মহত্তর সচেতনতার মাধ্যমে মূর্ত হওয়ার দিকে এক ধাপ অগ্রসর হয়।
  তাহলে, ওই যোগীর চেহারাটি কমবেশি আমার জন্মপূর্বের অচেতনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর, দূর প্রাচ্য, স্বপ্নে যা প্রায়ই আসে, সে আসলে একটা ভিন্ন ও আমাদের নিজেদেরই বিপরীত এক মনের অবস্থা। ওই ম্যাজিক লন্ঠনের মতো, যোগীর ধ্যানটি আমার প্রায়োগিক বাস্তবতাকে রূপদান করে। নিয়মানুসারেই, আমরা এই আলগা সম্পর্কটিকে বিপরীতভাবে দেখিঃ অচেতনের প্রোডাক্টগুলির মধ্যে আমরা ‘মন্ডল’ (mandala) প্রতীকসমূহ আবিষ্কার করি। অর্থাৎ বৃত্তাকার ও চতুঃসংখ্যক রূপ যা ‘সমগ্র’ কে প্রকাশ করে, এবং যখনই আমরা সমগ্রকে প্রকাশ করতে চাই, তখনই আমরা এরকম রূপগুলোকেই কাজে লাগাই। আমাদের ভিত্তি হল অহং-সচেতনতা, আমাদের জগৎ অহং কে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা আলোর ক্ষেত্রবিশেষ। ওই বিন্দু থেকেই আমরা এক হেঁয়ালিভরা অস্পষ্টতার জগতকে দেখি, কখনো জানতেও পারিনা যে ছায়াময় গড়নগুলি আমরা দেখি তার কতটা আমাদের সচেতন থেকে আসে অথবা কতটা নিজস্ব বাস্তবকে তারা ধারণ করে। অগভীর পর্যবেক্ষকটি প্রথম ধারণা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন। কিন্তু আরও গভীর গবেষণায় দেখা যায় যে নিয়মানুসারে অচেতনের ছবিগুলি সচেতন থেকে উৎপন্ন হয়না। বরং তাদের নিজস্ব বাস্তবতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। তবুও, আমরা তাদের কেবলমাত্র প্রান্তিক ঘটনা বলেই গণ্য করি।

   এই দুটি স্বপ্নেরই উদ্দেশ্য হল অহং-সচেতনতা ও অচেতনের মধ্যেকার সম্পর্কটাকে উলটো করে দেওয়ার চেষ্টা করা এবং অচেতনকেই প্রায়োগিক ব্যক্তিত্বের উৎস হিসেবে তুলে ধরা। এই উলটপুরাণ বলতে চায় যে, ‘অন্যপক্ষ’-এর মতে, আমাদের অচেতন অস্তিত্বই আসলে প্রকৃত অস্তিত্ব এবং সচেতন জগৎ হল একধরণের বিভ্রম (illusion), একটা বাহ্যিক বাস্তব যেটা একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে, যেমনভাবে একটা স্বপ্নকে আমাদের সত্যি মনে হয় যতক্ষণ তার ভেতরে থাকি আমরা। এইধরণের ব্যাপারগুলো প্রাচ্যের ‘মায়া’ ধারণাটির সঙ্গে খুবই মিলে যায়।

মানুষের চূড়ান্ত প্রশ্নটি হলঃ সে কি কোনো অসীমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না সম্পর্কযুক্ত নয়? যদি আমরা জানতে পারি যে অসীমই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ, শুধু তখনই আমরা তুচ্ছ জিনিষের প্রতি আসক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারবো এবং সত্যিকারের কোনো গুরুত্ব নেই এরকম লক্ষ্য থেকে সরে আসতে পারবো। এইভাবে, আমরা দাবী করি যে, এই পৃথিবী -আমরা যে সব গুণাবলীকে ব্যক্তিগত সম্পদ বলে ভাবি -তাদের স্বীকৃতি দিক। যেমন আমাদের প্রতিভা কিংবা আমাদের সৌন্দর্য্য। যতই মানুষ মিথ্যে সম্পদের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করে, এবং যতই সে যা আবশ্যকীয় তার জন্য কম সংবেদনশীলতা দেখায়, ততই কম পরিতৃপ্তির হয়ে ওঠে তার জীবন। তার নিজেকে সীমিত মনে হয় কারণ তার লক্ষ্যও সীমিত। আর ফলাফল দাঁড়ায় দ্বেষ এবং ঈর্ষা। যদি আমরা বুঝতে পারি যে এইখানে এই জীবনেই অসীমের সঙ্গে যোগ আছে আমাদের, আকাঙ্খা ও দৃষ্টিভঙ্গী বদলে যাবে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, আমরা কোনো জিনিষকে গুরুত্ব দিই কারণ আমরা আবশ্যকীয়কে মূর্ত করে তুলি, এবং আমরা যদি তাদের মূর্ত না করে তুলি তাহলে জীবনটিরই অপচয় হয়। অন্য মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, একটা অবাধ ব্যাপার সেই সম্পর্কের মধ্যে প্রতিভাত হচ্ছে কিনা।
যাইহোক, অসীমের প্রতি এই অনুভূতি কেবলমাত্র তখনই অর্জন করা সম্ভব যদি আমরা পরমের সঙ্গে বাঁধা থাকি। মানুষের সর্বোচ্চ সীমাবদ্ধতা হল ‘আত্মন্‌’; এটা এই অভিজ্ঞতাটায় ফুটে ওঠেঃ “আমি কেবল এটাই!” এই ‘আত্মন্‌’এর মধ্যে সংকীর্ণভাবে বন্দী থাকার চেতনাই কেবলমাত্র আমাদের অচেতনের অসীমত্ব’র সঙ্গে সংযোগস্থাপন করে দেয়। এইরকম একটা সচেতনতায়, আমরা নিজেদের একইসঙ্গে সসীম এবং শাশ্বত হিসেবে বোধ করতে পারি, একইসঙ্গে এটা আবার অন্যটাও। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ছকে অনন্য – এটা জানা মানে হল চরম সীমাবদ্ধ একটা ব্যাপার – অসীম সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠতে পারার সক্ষমতাও আমাদের আছে। কিন্তু কেবল তখনই!
যে কোনো মূল্যে বসবাসযোগ্য স্থান ও যৌক্তিক জ্ঞানকে বাড়িয়ে তোলার দিকেই মনোযোগ দিয়েছে যে যুগ, সেসময় মানুষকে তার অনন্যতা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হতে বলাটাই একটা চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ। অনন্যতা এবং সীমাবদ্ধতা আসলে সমার্থক। এদের ছাড়া অসীমত্বের কোনো ধারণা গড়ে তোলা সম্ভব নয় – এবং ফলত, কোনো সচেতনতাও না – শুধু থাকে একটা ভ্রান্ত পরিচয় যা বৃহৎ অংশের মানুষের কাছেই নেশার রূপ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি লিপ্সার রূপ ধারণ করে।     

আমাদের সময়খন্ড তার সমস্ত ঝোঁক আরোপ করেছে ‘এইখানে’ আর ‘এখন’ এর দিকে, এবং এইভাবে মানুষ এবং তার পৃথিবীর ‘daimonisation’** ঘটিয়ে ফেলেছে। স্বৈরাচারীরা যা যা দুর্দশা তৈরি করে তা এই ঘটনা থেকে আসে যে, অতি-বুদ্ধিজীবিদের দৃষ্টির স্বল্পতার কারণে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষমতা মানুষ হারিয়ে ফেলেছে । তাদের মতো সেও অচেতনের শিকার হয়ে পড়েছে। কিন্তু মানুষের কাজ আসলে ঠিক বিপরীতঃ সেইসমস্ত জিনিষের সম্বন্ধে সচেতন হওয়া যা অচেতন থেকে উপরের দিকে উঠে আসে। যেমন তার অচেতনের প্রতি জেদ ধরে থাকা উচিত নয়, তেমনি তার সত্তার অচেতন উপাদানগুলির সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে পড়াও উচিত না। এইভাবে যেন সে তার ভাগ্যকে এড়িয়ে যেতে পারে, যেন আরও আরও বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়। যদ্দুর পর্যন্ত আমরা নির্ধারণ করতে পারি, দেখি যে, মানব অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য হল শুধু এই সত্তার ভেতরে একটা আলো জ্বালানো। এমনটাও ভাবা যেতে পারে যে, ঠিক যেমন অচেতন আমাদের প্রভাবিত করে, তেমনি আমাদের সচেতন-এর বৃদ্ধিও প্রভাব ফেলে অচেতনের ওপর।









(**অনুবাদকের নোটঃ daimonisation আর demonization এক নয়। হিথার মার্টিন নামের একজন সমালোচক ইয়েটস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখছেন, “Daimon হল ব্যক্তিমানুষের সেই অংশ যা টাইম-স্পেস এর সীমার বাইরে অবস্থান করে, সেই অপর সত্তা যার সঙ্গে সে সময়-এর শেষে গিয়ে মিলিত হবে ... এখন এমন মনে হয় যে, daimon ব্যক্তিমানুষের ভেতরেই থাকতে পারে, তার সচেতন জীবনের পেছনদিকে সেই ‘সমাধিস্থ সত্তা’র ভেতরেই।“
সৃজনশীল লোকেরা এই daimon কে তাদের মিউজ এর কাছ থেকে পাওয়া একটা উপহার হিসেবেই ভেবে নিতে পারে –এর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নিয়ে বিলাপ করতে পারে। মনস্তত্বে daimonic কে এভাবেও দেখা যায় যে এটা প্রত্যেকের ভেতরকার একটা অস্থিরতা যা একজন ব্যক্তি কিংবা কোনো সংস্কৃতিকে অজানা’র (unknown) দিকে নিয়ে যায়, আত্মধ্বংস কিংবা আত্ম-আবিষ্কার ঘটে।)  

                      

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে