Sunday, October 14, 2018

সাক্ষাৎকার-উইলিয়ম ফকনারঃ দ্য আর্ট অফ ফিকশন (ভাষান্তরঃ রিমি মুৎসুদ্দি)






উইলিয়ম ফকনারঃ দ্য আর্ট অফ ফিকশন

প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষঃ সাক্ষাৎকার 

নিয়েছেন জ্যাঁ স্টেইন



মিসিসিপির নিউ অ্যালবেনিতে জন্মগ্রহণ করেন নোবেলজয়ী ২০-এর দশকের ইংরাজি ভাষার বিখ্যাত উপনাস্যিক উইলিয়াম ফকনার। তাঁর বাবা একজন রেলকর্মী ছিলেন এবং দাদু কর্ণেল ফকনার ছিলেন ‘দ্য ওয়াইট রোজ মেমফিস’-এর লেখক। তাঁর শৈশবেই পুরো পরিবার মিসিসিপি থেকে অক্সফোর্ডে স্থানান্তরিত হয়। সারাদিন পড়াশোনায় ডুবে থাকা সত্ত্বেও ফকনার কিন্তু বাড়ী থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নম্বর পাননি। ১৯১৮ সালে তিনি রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ারফোর্সে শিক্ষানবিশ হিসাবে যোগ দেন। অতিরিক্ত বইপড়ার কারণে একবার চাকরি থেকেও বাদ পড়েন তিনি।

তাঁর লেখা প্রথম বই ‘সোলজারস পে’(১৯২৬) খুব একটা পাঠক প্রিয় হয় না। পরবর্তীকালে ‘মসকিউটোস’ ‘দ্যা সাউণ্ড এণ্ড দ্যা ফারি’, ‘অ্যাস আই লে ডাউন’ এবং ‘স্যাংচুয়ারি’-এই বইগুলোর মধ্যে , ‘স্যাংচুয়ারি’(১৯৩১) খুবই জনপ্রিয় হয়।  ‘লাইট ইন অগস্ট’ (১৯৩২), ‘পাইলন’(১৯৩৫), ‘অ্যাবসালম, অ্যাবসালম’(১৯৩৬)  ‘দ্য আনভ্যাংকুয়িশড’(১৯৩৮), ‘দ্য ওয়াইল্ড পাম’(১৯৩৯), ‘দ্য হ্যামলেট’(১৯৪০) ইত্যাদি বহুলপঠিত উপন্যাস ও বেশ কয়েকটি ছোটোগল্প তিনি লিখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সেই সময় সমস্ত ইংরাজি সাহিত্যেই ছাপ ফেলেছিল। হেমিংওয়ে, সল বেলো, ফকনার প্রত্যেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে বেশ কিছু গল্প উপন্যাস লিখেছেন। ফকনারের লেখা ‘ইন দ্যা ডাস্ট,’(১৯৪৮) ‘দ্যা টাউন’,(১৯৫৪) ‘অ্যা ফেবল’(১৯৫৭) উল্লেখযোগ্য।
ছোটোগল্পেও তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ‘অ্যা রোজ ফর এমিলি’, ‘রেড লিভস’, ‘দ্যাট ইভনিং সান’, ‘ড্রাই সেপ্টেম্বর’ ইত্যাদি ছোটোগল্পের সংকলন পাঠক সমাদৃত। ছোটোগল্পের জন্য তিনি পেয়েছিলেন ‘ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড’।
১৯৪৯-এ ফকনার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। ১৯৫৫ ও ১৯৬৩-তে দুবার পুলিতজার সম্মানেও ভূষিত হন।

 নিউইয়র্ক শহরে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন জ্যাঁ স্টেইন।

জ্যাঁঃ আপনি তো সাক্ষাৎকার দেওয়া একেবারেই পচ্ছন্দ করেন না?
ফকনারঃ হ্যাঁ। তার কারণ আমি ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা পচ্ছন্দ করি না। প্রশ্নগুলো যদি কাজ সংক্রান্ত হয়, আমার উত্তর দিতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রশ্নে হয় আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে যা কিছু একটা বলে দিতে পারি। অথবা কিছুই না বলতে পারি। আবার ধরুন কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্নের আমি আজ আপনাকে উত্তর দিলাম একরকম। আগামীকালই আপনি যদি আবার একই প্রশ্ন করেন, আমার উত্তরটা ভিন্ন হবে।
জ্যাঁঃ আপনি নিজেকে লেখক হিসাবে এইসময় কিভাবে দেখবেন?
ফকনারঃ আমি যদি না লিখতাম অন্যকেউ আমার হয়ে লিখত। শুধু আমি কেন, হেমিংওয়ে, দস্তভয়স্কি আমরা যে কেউই না লিখলেও অন্যকেউ লিখতই। সেক্সপিয়ারের হ্যামলেট অথবা মিডসামারস নাইটস ড্রিম এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে লেখককেও ছাপিয়ে গেছে এই লেখাগুলো। আমি মনে করি সৃষ্টিকর্তা নয় সৃষ্টিই জরুরী। সেক্সপিয়ার, বালজাক, হোমার যদি এই সময়েও বেঁচে থাকতেন তাহলে কোনো প্রকাশকই অন্যকোনো লেখকের লেখার প্রতি উৎসাহই রাখতেন না।
জ্যাঃ তাহলেও কি লেখকের নিজস্বতা গুরুত্বপূর্ণ নয়?
ফকনারঃ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক লেখকেরই এই নিজস্বতার প্রতিই অত্যন্ত যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।
জ্যাঁঃ আপনার সমসাময়িক লেখকরা কি সেই নিজস্বতা বজায় রাখতে পেরেছেন?
ফকনারঃ আমরা প্রত্যকেই আমাদের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থ হয়েছি। আমি সেইজন্যই আমাদের প্রত্যেককেই আমাদের ব্যর্থতার সারিতেই মূল্যায়ন করতে চাইব। এবং সেই ব্যর্থতা হল অসম্ভবকে ছোঁয়া। আমার ব্যক্তিগত মত হল, আমি যদি আমারই লেখাগুলোই আরেকবার লিখতে পারতাম তাহলে সেই লেখাগুলো আরো অনেক ভাল হত। যেকোনো শিল্পীরই তাঁর শিল্পসৃষ্টির প্রতি এই মনোভাব জরুরী। একজন শিল্পী সবসময়ই মনে করবেন এইবার তাঁর কাজ আগের কাজগুলোর চেয়েও আরো অনেক ভাল হবে। যে মুহুর্তে একজন তাঁর কাজ নিয়ে খুশী হবেন এবং ভাববেন এইবার ঠিকমতো করতে পেরেছেন সেইমুহুর্তেই শিল্পের মৃত্যু। বলা ভাল, শিল্পীর আত্মহনন। তাই নিজের কাজ নিয়ে অসন্তোষই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
যেমন ধরুন, প্রতিটা উপনাস্যিক প্রথমে কবিতা লেখার চেষ্টা করেন। কবিতা লিখতে ব্যর্থ হলে তারপর তিনি গল্প লেখার চেষ্টা করেন। কবিতার পরই সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় গল্প। এরপর গল্প লিখতে ব্যর্থ হলেও তিনি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেন।

জ্যাঁঃ একজন সফল উপন্যাসিক হওয়ার কোনো ফর্মূলা আছে বলে আপনি মনে করেন?
ফকনারঃ ৯৯ শতাংশ ট্যালেন্ট, ৯৯ শতাং নিয়মানুবর্তিতা, ৯৯ শতাংশ কাজ। একজন উপন্যাসিক কখনওই নিজের কাজে সম্পূর্ণ খুশী হবেন না। তাঁর নিজের কাজে তাঁর কখনওই মনে হওয়া উচিত নয় যে তিনি যেমন চেয়েছিলেন ঠিক তেমনই করতে পেরেছেন। আপনার ক্ষমতার থেকেও আপনার স্বপ্ন অধিক হওয়া প্রয়োজন। নিজের সমসাময়িক বা অগ্রজ সাহিত্যিকদের থেকে আরো বেশি ভাল করার ভাবনার চেয়ে নিজেকে জয় করার ভাবনা জরুরী। নিজের আগের কাজ থেকে পরের কাজটা আরো বেশি ভাল হচ্ছে কিনা সেটাই জরুরী।
একজন শিল্পী সবসময়ই একটি দানব দ্বারা পরিচালিত জীব। সে জানেনা এই দানবটি কেন তাকেই বেছে নিয়েছে? এবং সেই কারণ খুঁজতেই তার শিল্পসৃষ্টি। নিজের কাজটুকু শেষ করার জন্য একজন শিল্পী চুরি, ডাকাতি বা যাকিছুই করতে পারেন।
জ্যাঁঃ আপনি কি তাহলে মনে করেন একজন লেখক তাহলে দয়ামায়াহীন সম্পূর্ণ কঠিন কঠোর নিষ্ঠুর প্রকৃতির হবেন?
ফকনারঃ একজন লেখকের একমাত্র দায়িত্ব তাঁর লেখার প্রতি। তিনি যদি তাঁর লেখার প্রতি সত্যিই দায়িত্বশীল হন তাহলে তাঁকে সম্পূর্ণ কঠোর হতে হবে। তাঁর একটা নিজস্ব স্বপ্ন থাকবে এবং সেই স্বপ্ন এমনভাবে তাঁকে যন্ত্রণা দেবে যে তিনি তা থেকে মুক্তি চাইবেন। সম্মান, সুখ, আনন্দ, নিরাপত্তা সবকিছু ভুলে তিনি শুধু নিজের কাজটুকু অর্থাৎ লেখা শেষ করতে চাইবেন। একটা বই সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজন হলে নিজের মা র থেকেও টাকা তাঁকে ছিনিয়ে নিতে দ্বিধাগ্রস্থ হলে চলবে না।
জ্যাঁঃ তাহলে আপনি বলতে চাইছেন সুখ, সম্মান আর নিরপত্তার অভাবই একজন শিল্পীর সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে?
ফকনারঃ না। ঠিক তা বলতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি সুখ, সম্মান আর নিরাপত্তা জরুরী একমাত্র শান্তি ও তাঁর নিজের পরিতৃপ্তির জন্য। শিল্পের সাথে শান্তি বা তৃপ্তির কোনো সম্পর্কই নেই।
জ্যাঁঃ একজন লেখকের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তাহলে কীরকম হওয়া উচিত?
ফকনারঃ শিল্পের সাথে পরিবেশের কোনো সম্পর্কই নেই। আপনি যদি আমার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ জিজ্ঞেস করেন তাহলে আমি বলব একটা বেশ্যালয়ের যদি আমি মালিক হতাম তাহলে তা হত আমার লেখার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। আমার মতে বেশ্যালয় যেকোনো শিল্পীরই একেবারে যথার্থ পরিবেশ। এখানে শিল্পীর মাথার ওপর একটা ছাদ আছে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আছে। আর লেখা ছাড়া কোনো কাজও তাঁকে করতে হচ্ছে না। শুধু কয়েকটা আয়ব্যায়ের হিসাব ও স্থানীয় থানায় সময়মতো উৎকোচ। এইটুকুই।  
দিনেরবেলায় বেশ্যালয়গুলো একদম শান্ত থাকে। এইসময়ে একজন শিল্পীর কাজ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। আর রাতের বেলায় এখানের হইচইতে যোগ দিয়ে নিজেকে সামাজিক মনে করতে পারে সে। যেহেতু সেখানের বাসিন্দারা সবাই মেয়ে তাই তারা প্রত্যেকেই তাঁকে সম্মান জানাবে। আবার যারা পরিষেবা পেতে আসছে তারাও বাড়তি কিছু সুযোগ সুবিধার জন্য তাঁকে সম্মান করবে। আর স্থানীয় পুলিশকর্তাকে আপনি নামধরেই ডাকতে পারবেন কারণ, পুলিশ একদিকে উৎকোচ ও পরিষেবা দুটোই চাইবে।
সেইজন্য একজন আর্টিস্টের জন্য জরুরী এমন একটা পরিবেশ যেখানে শান্তি, তৃপ্তি সবই রয়েছে অথচ তার মূল্য অত্যন্ত কম হবে। আবেগময় একটা ভুল পরিবেশ শুধুমাত্র তাঁর উচ্চরক্তচাপ বাড়িয়ে তাঁর হতাশা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে এবং এর ফলে সৃষ্টিশীলতার ক্ষতি। আমার নিজের কাজের জন্য প্রয়োজন অল্প খাবার, একটু তামাক ও একটু উইস্কি।
জ্যাঁঃ কোনো বিশেষ পচ্ছন্দ? উইস্কির প্রতি?
ফকনারঃ স্কচ আর অন্যকিছুর মধ্যে আমি স্কচ পছন্দ করি।
জ্যাঁঃ আপনি একটু আগে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বললেন। একজন লেখক কি তাহলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজন অনুভব করেন?
ফকনারঃ না, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। একজন লেখকের শুধু প্রয়োজন একটা পেন্সিল আর পেপার। আমার এরকমও হয়েছে কেউ আমায় অর্থ উপহার দিয়েছে। কিন্তু তার পরিবর্তে আমি ভাল লেখা লিখতে পারিনি। একজন প্রকৃত লেখকের কোনো প্রতিষ্ঠানেরও প্রয়োজন নেই। তাঁর সবসময়ই কিছু না কিছু লেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকা উচিত। তিনি যদি তা না করে অজুহাত দেন যে তাঁর সময় নেই অথবা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বলে তিনি লিখতে পারছেন না। তাহলে এটা তাঁর অত্যন্ত মূর্খামি। একজন চোর, স্মাগলার বা ঘোড়ার রেসের জুয়ারি, যে কেউই একটা ভাল শিল্প সৃষ্টি করতে পারেন।
দারিদ্র্য বা কোনো কঠিন সংগ্রামই শিল্পকে ধ্বংস করতে পারেনা। কোনো প্রতিকূলতাই একজন প্রকৃত লেখককে থামাতে পারেনা। একমাত্র মৃত্যুই তাঁর কলম থামাতে পারে। কোনো লেখকেরই সাফল্যের কথা মাথায় রাখা উচিত নয়। কারণ, সাফল্য ঠিক যেন একটি সুন্দরী নারী। যার জন্য একজন পুরুষ যত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবে সেই রমণী ততই পুরুষটির থেকে দূরে সরে যাবে। আর উল্টোটা হলে নারী নিজেই পুরুষের কাছে আসতে চাইবেন। সাফল্যকেও এভাবেই দেখা উচিত। একেবারেই গুরুত্ব না দিয়ে শুধু কাজটুকু যথাযথভাবে করে যাওয়া উচিত।              
  

2 comments:

  1. খুব মূল্যবান সাক্ষাৎকার। ভালো লাগল রিমি।

    ReplyDelete
  2. খুব মূল্যবান সাক্ষাৎকার। ভালো লাগল রিমি।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে